ড. শোয়েব সাঈদ: কোভিড রাজনীতির বিশ্বগুরু ছিলেন ট্রাম্প, তবে ষড়যন্ত্রের চাইতে বেশি ঝামেলা পাকিয়েছেন স্বভাবজাত গোঁয়ার্তুমির কারণে। বলা যায় এই কোভিড রাজনীতিই শেষতক ধরাশায়ী করেছে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের এই প্রেরিত পূজিত পুরুষকে। বৈশ্বিকভাবে ভ্যাকসিন নিয়েও নানা রাজনীতি, তবে এটি ভ্যাকসিনকে নিজের কব্জায় আনার জন্যে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের নামে; ভ্যাকসিনকে হেয় করার জন্যে নয়। বাংলাদেশ তো সবকিছুতেই দু-পা এগিয়ে। ভ্যাকসিন নিয়ে নানা গুঞ্জনের চর্চা বিশ্বে স্তিমিত হয়ে আসলেও বাংলাদেশে অব্যাহত গুঞ্জনের নানাবিধ নতুন চর্চা। রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে পটু সাংবাদিক যখন বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেন একটু হুশে বললে ভালো হয়, বিভ্রান্তিটা কারো জন্যেই মঙ্গলজনক নয়।
ভ্যারিয়েন্ট, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক ভাষ্যকার সাংবাদিকদের বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রেই অল্প বিদ্যা ভয়ংকরীর মতো সাংঘাতিক হয়ে উঠছে। আমাদের কালচার অবশ্য এই প্রবণতার অনুক‚লে। বাংলাদেশে টক শো গুলোতে গবেষণা কালচার অর্থাৎ সঠিক মানুষকে দিয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশের চর্চা তৈরি হয়নি। ফলে রিজেন্ট শাহেদদের মতো বাটপাররাই হয়ে উঠেন রিসোর্স পারসন, দিনের পর দিন মিডিয়াতে জাতিকে হেদায়েত করে যেতে পারেন। একটি দেশের মিডিয়া যেমন দেশটির রুচিকে ধারণ করে তেমনি উন্নততর রুচি সংস্থানেও ভূমিকা পালন করে।
আমাদের দেশে শেষের চিত্রটি উপেক্ষিত। একজন দায়িত্বশীল মানুষ, রাজনীতিবিদ হওন বা বিজ্ঞানী হওন গণমাধ্যমে কথা বলার সময় দায়িত্ব নিয়েই কথা বলবেন, এটি একটি সঙ্গত প্রত্যাশা। এখনকার যুগে সামাজিক মাধ্যমে নানা অসংলগ্ন তথ্যের সমাহার। আপনি যদি প্রজ্ঞাবান আর বিষয়ভিত্তিক দক্ষ না হন, তথ্যের সঠিকতা নিয়ে সংশয়পূর্ণ চাহনিটা দিতে পারবেন না, ফলে অসংলগ্ন তথ্যটিকে রাজনৈতিক সুবিধে অর্জনে ব্যবহারে আপনার অরুচি হবে না, যাচাই বাছাই করতেও ইচ্ছে হবে না। দেখা যাবে কোনো প্রতিবেদনের খণ্ডাংশের উপর অপরিপক্ক উপসংহারে বিভ্রান্ত করছেন দর্শকদের। অপরিপক্ক উপসংহারের পরিণতি তো আমরা দেখেছি গণস্বাস্থ্যের এন্টিবডি কিটের বেলায়। ভীষণ হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ড. বিজন আর এন্টিবডি কিটের কথা ভুলতে বসেছে পাঠকরা। ভ্যাকসিন রোলআউটের এই সময়ে জনগণের ভ্যাকসিন আর সংক্রমণ থেকে উদ্ভূত এন্টিবডি নির্ণয়ে এই মুহূর্তে দরকার ছিল এই ধরণের একটি কিটের।
কিছু মিডিয়ার ইন্ধনে অপরিপক্ক প্রচারণায় কোভিড নির্ণয়ে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড আরটিপিসিআরের বিপরীতে এই কিটকে দাড় করিয়ে পুরো প্রচেষ্টাকেই ভণ্ডুল করে দেওয়া হয়। গণস্বাস্থ্য আর ড. বিজনের এই কিটের প্রবল জনপ্রিয় জনমতের বিপরীতে গালি খাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে বারবার সতর্ক করেছি ঘোড়ার আগে গাড়ি না জুড়াতে, বিজ্ঞানের ইন্টেগ্রিটিটাকে কম্প্রোমাইজ না করতে। শেষমেশ গবেষণাগার ছেড়ে অসুস্থ প্রচারণার কাছে আশ্রিত হতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব কিটের সম্ভাবনাকে হারতে হলো। গ্লোব-বায়োটেকের ভ্যাকসিন নিয়ে শুরুতেই মিডিয়া হৈচৈ এর বিপরীতে দেশ প্রেমের টানে ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণ দিয়ে কলাম লিখেছিলাম।
আবিষ্কার নিয়ে আগ বাড়িয়ে অতিশয় উক্তি দিনশেষে শুধু বুমেরাং নয়, গবেষকদের উপর অহেতুক চাপ তৈরি করে। গ্লোব বায়োটেকের বিজ্ঞানীদের সাথে একাধিক টক শো তে কারিগরী বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অনুজীব বিদ্যার বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমার পর্যবেক্ষণে তারা দ্বিমত পোষণ করেননি। বিজ্ঞানটাকে রাজনীতি আর আবেগে মুড়িয়ে দিলে আসল উদ্ভাবনটা হারিয়ে যায়। পশ্চিমা মিডিয়ায় কোভিড আর ভ্যাকসিন নিয়ে যারা রিপোর্ট করেন, তাদের জ্ঞানের পরিসরকে স্যালুট না জানিয়ে উপায় থাকে না। অহেতুক আবেগ আর প্রিজুডিসড ধারণার ঊর্ধ্বে গিয়ে বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টে লিখতে পারেন বলেই বিজ্ঞানী না হয়েও তারা প্রজ্ঞাবান আর সফল বিজ্ঞান সাংবাদিক। গত এক বছরে বাংলাদেশে কোভিড নিয়ে আমার চর্চা আর পর্যবেক্ষণে দেখলাম ফ্যাক্টের চাইতে, রাজনীতি, গুজব আর কুসংস্কারের প্রবল প্রতাপ।
আমাদের সমাজে এটি অবশ্য আশ্চর্য হবার বিষয় নয় এবং স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাকসিন নিয়েও একই গসিপিং। তবে গসিপিংটা অস্থায়ী আর বিজ্ঞানটা স্থায়ী, ফলে দিনশেষে টিকাদান আস্থায় অভিষিক্ত। আবার দেখছি নতুন গসিপিং, ভ্যাকসিন বনাম ভ্যারিয়েন্ট। খুবই আংশিক বা স্বল্প ধারণায় এই সব টেকনিক্যাল বিষয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করাটা দায়িত্বশীলতার কাজ নয়।
ভ্যাকসিনের বৈশ্বিক সফলতার চিত্রটি অত্যন্ত পরিস্কার। সফলতার বড় উদাহরণ যুক্তরাজ্য আর ইসরায়েল। মজার বিষয় তথাকথিত এই ইহুদী নাসারাদের পাশাপাশি মুমিন মুসলমানের দেশ ইউএই, বাহরাইন ভ্যাকসিনে অনেক এগিয়ে গেছে। ভ্যাকসিনের প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে কোভিডে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে। সংক্রমণের হার দ্রুতগতিতে নিন্মমুখী। ভ্যাকসিন রাজনীতি বা ধর্মকে চেনে না, চেনে কোভিডকে, বিজ্ঞানকে। কানাডায় টেস্ট করা মানুষদের মাঝে সংক্রমণ প্রায় ৫ শতাংশ। বয়স্ক হোমে সংক্রমণ ছিল ১২ শতাংশ, টিকাদান বয়স্কদের দিয়ে শুরুর করার সুফলে এখন তা ০.৬ শতাংশ এ নেমে এসেছে।
সরবরাহ জটিলতা কাটিয়ে এই সপ্তাহে কানাডার টিকাদান আবার গতিতে ফিরেছে, প্রতি সপ্তাহেই আসছে ফাইজার, মডার্নার লাখ লাখ ভ্যাকসিন, এপ্রিল নাগাদ আসবে কোটি কোটি। ভ্যাকসিন চলছে ৮৫ বছর বয়স্কদের, তারপর ৭৫, ৬৫, ৫৫ এভাবে কম ঝুঁকি প্রবণদের দিকে যাবে। রাজনীতির মোড়কে বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলে বাংলাদেশের সমাজে টিআরপি বাড়বে বটে, কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের কাছে ক্রেডিবিলিটি শুন্য হয়ে যাবে। লেখক: অনুজীব বিজ্ঞানী
আপনার মতামত লিখুন :