ডেস্ক রিপোর্ট: করোনাকালে তেমন একটা বার্ডিং করা হয়নি। মহামারির জন্য পাখি দেখার সাথী বা বার্ডিংমেটদের একসঙ্গে করতে পারছি না। কাজেই শুক্রবারের এক সকালে স্ত্রী নুসরাত জাহানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম মিরপুরের ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। একটি নিমপ্যাঁচাকে (Collared Scops-owl) তার পুরোনো জায়গায় খুঁজে না পেয়ে ফুলে ভরা রৌদ্রোজ্জ্বল প্রজাপতির মেলায় খানিকক্ষণ ঘুরলাম। বেশকিছু পরিচিত প্রজাপতির সুন্দর ছবি তুলে বাঁশবনের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর এক জোড়া ঘুমকাতুরে নিমপ্যাঁচার ছবি তুলে বাঁশবনের ভেতরের দিকে ঢুকলাম। উদ্দেশ্য সবুজ রঙের পুরোনো একটি পাখির ছবি তোলা। শেষবার ওর এমন ছবি তুলেছিলাম, যা দেখলে মনে হবে, সে আমার ওপর রাগ করে পেছনমুখী হয়ে বসে আছে। হঠাৎ পক্ষী আলোকচিত্রী নজিমের দেখা মিলল। তাকে জিজ্ঞেস করতেই ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার, আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখেন। অন্যদের দেখাতে চাই না; ওরা পাখিটিকে বিরক্ত করতে পারে।’ বিষয়টা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না। দ্রুততার সঙ্গে ডিমে তা দেওয়া পাখিটির অল্প ক’টি ছবি তুলেই সেখান থেকে সরে পড়লাম। প্রথমবার ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের হিলসভিলে পাখিটির ছবি তুলেছিলাম।
ডিমে তা দানরত সবুজ রঙের পাখিটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি বাঁশঘুঘু বা সবুজ ঘুঘু। পশ্চিমবঙ্গে পরিচিত রাজ ঘুঘু নামে। ইংরেজি নাম Grey-capped Emerald Dove, Emerald Dove, Asian Emarald Dove, Green Dove বা Green-winged Pigeon| Columbidae গোত্রের ঘুঘুটির বৈজ্ঞানিক নাম Chalcophas indica। পাকিস্তান বাদে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, অর্থাৎ ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত ওরা বিস্তৃত।
বাঁশঘুঘু লম্বায় ২৬-২৭ সেন্টিমিটার, ওজনে ১৩০-১৩৫ গ্রাম। ডানা ও পিঠ সবুজ। পিঠের নিচে দুটি সাদা দাগ রয়েছে। দাগ দুটির মাঝ বরাবর একটি কালো দাগ। পায়রার দেহের ওপরটা চকচকে পান্না সবুজ। মাথা ধূসর; কপাল, থুতনি ও ভ্রূ সাদা। কাঁধের ওপর ছোট সাদা দাগ। লেজ ও ডানার ওড়ার পালক কালচে। মাথার দু’পাশ ও দেহের নিচটা সুন্দর লালচে-বাদামি বা গোলাপি-বাদামি। পায়রি দেখতে পায়রার মতো হলেও মাথা, থুতনি ও কাঁধের ওপরটা বাদামি। কপাল ও ভ্রূ ধূসর। দেহের নিচটা গাঢ় বাদামি। চোখের রং বাদামি। পায়রা-পায়রি উভয়ের চঞ্চু উজ্জ্বল বা গোলাপি-লাল। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল গোলাপি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি
দেখতে পায়রির মতো হলেও চঞ্চুর রং বাদামি-ধূসর ও কপালে দুটি ধূসর দাগ রয়েছে। পাছা লালচে-বাদামি এবং গলা ও দেহের নিচের পালকের প্রান্ত হলদে। পূর্বরাগের সময় পায়রা গোঙানোর মতো করে ‘হু-হু-হুন …’ শব্দে ডাকে।
বাঁশঘুঘু মূলত পাতাঝরা, চিরসবুজ, শাল ও বাঁশবনের বাসিন্দা। সুন্দরবনে প্রচুর আছে। এক সময় গ্রামেও দেখা যেত। কিন্তু ঘুঘু শিকারিদের অত্যাচার এবং বাঁশঝাড় ও ঝোপ-জঙ্গল কমে যাওয়ায় বর্তমানে তেমন চোখে পড়ে না। তবে, ২০১২ সালের জুলাই মাসে ওদের একটিকে ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামে দেখেছিলাম। ওরা একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে থাকে। গাছ বা বাঁশঝাড়ের তলায় হেঁটে হেঁটে শস্যদানা, ফল, বিচি ও উইপোকা খায়। বনের ধারে নির্জন খোলা জায়গা কিংবা রাস্তার ধারে খুব ভোরে, ভরদুপুরে বা সন্ধ্যার আগে আগে খাবার খেতে নামে। বনের ভেতরে অত্যন্ত কম উচ্চতায়ও বেশ দ্রুতগতিতে উড়তে পারে; যেমনটা দেখেছিলাম কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, ২০১৩ সালের ১৫ মার্চ।
ওরা মোটামুটি সারাবছর প্রজনন করে। ছোট গাছ, বাঁশঝাড় বা ঝোপঝাড়ে কয়েকটি কাঠি-কুটি জড়ো করে ছোট্ট ও অগোছালো বাসা বানায়। পায়রি ঘিয়ে বা হলদে রঙের দুটি ডিম পাড়ে। পায়রা-পায়রি মিলেমিশে তা দেয় ও ছানাদের যত্ন করে। ডিম ফোটে ১২ দিনে। ছানারা দুই সপ্তাহেই উড়তে পারে। আয়ুস্কাল পাঁচ-ছয় বছর।
লেখক :অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
সূত্র: সমকাল