শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২৭ দুপুর
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও স্বাধীনতা পুরস্কার

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান: বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে আর কয়েকদিন পর। এই স্বাধীনতার বীজ বোপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায়। সেদিনের সেই ক্ষুব্ধ তারুণ্য জন্ম দেয় এক নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনার। যার পথ ধরে চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৯৭১-এ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বললে যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দেয়া যাবে না, তেমনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নামটিও অবশ্য-স্মরণীয়। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এমন একটি প্রতিষ্ঠান, বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পদক্ষেপে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, প্রতিষ্ঠানটি আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রীয় পদক বা পুরস্কার পায়নি।

১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই ১০১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। এর কিছুদিন পর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই ভাষাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রটির পূর্বাংশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম নেয়। এ অসন্তোষের সুচনালগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ সময় বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের কেবিনে বসেই তিনি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নঈমুদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দিতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় এ তথ্য তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং অ্যালামনিবৃন্দের অবদান অপরিসীম। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা, দেশের চিকিৎসা পেশার মানোন্নয়ন এবং দেশের যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় এ কলেজের ছাত্র –ছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয়দফা, ’৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনসহ ইতিহাসের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে এ কলেজের চিকিৎসক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বীরোচিত ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কেবল দেশের ভেতরেই নয়, ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সবখানেই পেশাগত প্রতিভায় তারা দেদীপ্যমান।

ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ:
১৯৪৮ সালের মার্চে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন “উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। সেদিন থেকে পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই চাপা ক্ষোভ ১৯৫২ সালে আন্দোলনে রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ৪ জানুয়ারি সফল ছাত্র ধর্মটের পর শাসক গোষ্ঠী একুশে ফেব্রুয়ারি সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনেকেই ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে থাকলেও ছাত্রনেতারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঐতিহাসিক আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে, যেখানে নতুন অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে) প্রতিবাদী ছাত্রদের সভার পর ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল শুরু হয়। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও গ্রেপ্তারের ফলে শান্তিপূর্ণ মিছিল কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুপুরের পর পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে ব্যারাক চত্বর ও তার আশপাশে গুলির আঘাতে শহীদ হন রফিক, বরকত ও জব্বার। বরকতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা লাশগুলো বর্তমান ডিসেকশন হলের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন পরদিন জানাজার জন্য, কিন্তু রাতে পুলিশ তা ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আজিমপুর কবরস্থানে গোপনে দাফন করে।

ইতোমধ্যে পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতাল ও ব্যারাক চত্বরে মানুষের ঢল নামে। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে তখনকার ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ব্যারাকে অবস্থানরত ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে কন্ট্রোল রুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এই কন্ট্রোল রুম স্থাপন মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের একটি বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে এই কন্ট্রোল রুমেই রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার সংহতি প্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া কন্ট্রোল রুমের মাইক থেকেই নেতারা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ , রোববার, সরকারি ছুটির দিন। নবনির্মিত শহীদ মিনারটি প্রথমে উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ছুটির আরাম হারাম হয়ে যায়, যখন তিনি শুনতে পান স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং দলে দলে লোকের তা দর্শন ও মুখ্যমন্ত্রীকে ধিক্কার দেওয়ার কথা। শহীদ মিনার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার নতুন উদ্ভাস তৈরি করে।

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ :
মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক, তৎকালীন ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এদের অনেকেই অস্ত্র হাতে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় বাঙালিদের চিকিৎসা করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভুমিকা তিন ভাগে বর্ণনা করা যেতে পারে।
প্রথম ভাগে যারা এই সময় কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের তৎপরতা। দ্বিতীয় ভাগে এ কলেজ থেকে পাসকৃত চিকিৎসকদের একটি অংশ, তৃতীয় ভাগ হলো যারা অন্যান্য হাসপাতাল ও সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরে কর্মরত ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন।

এ কলেজের তৎকালীন ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন, সেলিম আহমেদ, আলী হাফিজ সেলিম, আবু ইউসুফ মিয়া, ইকবাল আহমেদ ফারুক, মুজিবুল হক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মোজাফফর, আমজাদ হোসেন, ওয়ালীত, ওসমান, গোলাম কবীর, জিলর রহিম, ডালু নুরুজ্জামান, শাহাদত প্রমুখ । এদের অনেকেই ঢাকা শহর কমান্ডের তত্ত্বাবধানে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন।
ছাত্রাবাসের ১0৭ নম্বর রুমে সে সময় রাজাকারদের ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন হামলায় হোস্টেল গেটে পাহারারত ২ জন রাজাকার নিহত হয়। গুলির শব্দ শুনে ১০৭ রুমে অবস্থানরত অন্য রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এদের একজন সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে নিহত হয়। একই দিনে তারা ২১৯ নম্বর রুমে হামলা চালায়। এ গ্রুপটি কলেজ ডিসেকশন হলেও বোমা হামলা চালিয়েছিল। এ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নিপা লাহিড়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ফতুল্লায় নিহন হন। আরেক ছাত্র সিরাজুল ইসলাম হাসপাতালে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। তিনি রাতে হোস্টেলে না গিয়ে হাসপাতালের ক্যানসার ওয়ার্ডে ঘুমাতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্রের সহায়তায় তাকে ১১ ডিসেম্বর রাতে রাজাকার বাহিনী ক্যানসার ওয়ার্ড থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

তৎকালীন সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্যদের মধ্যে স্কোয়াড়্রন লিডার এম শামসুল হক, মেজর খরশীদ, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফ মল্লিক, ক্যাপ্টেন মোশায়েফ হোসেন, ক্যাপ্টেন আ. মান্নান, লে. আখতার, লে. নুরুল ইসলাম প্রমুখ অফিসার বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন রশিদ বীরউত্তম ও লে. আখতার বীরপ্রতীক উপাধি পেযয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের যেসব সদস্য শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে ডা. লে. কর্নেল এএফ জিয়াউর রহমান, ডা. মেজর আসাদুল হক, ডা. লে. আমিনুল হক, ডা. লে. খন্দকার আবু জাফর মো. নুরুল ইমাম প্রমুখ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত প্রায় সব চিকিৎসকই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা আসল নাম গোপন রেখে হাসপাতালে ভর্তি হতেন। হাসপাতালে এসব কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন অধ্যাপক ফজলে রাব্বী। তিনি তাঁর আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। যুদ্ধের শেষ দিকে অধ্যাপক ফজলে রাব্বীসহ অনেক চিকিৎসককেই রাজাকার-আল বদর বাহিনী গোপন চিঠির মাধ্যমে মৃত্যুর ভয় দেখিয়েছিলেন।

তাদের চিঠির ভাষা ছিল, ‘কলকাতার মাড়োয়ারী দালালদের হত্যা করা হবে’। লাল কালির লেখা চিঠিতে একটি তরবারির প্রতিকৃতি আঁকা ছিল। তবে চিঠির নিচে প্রেরকের নাম ঠিকানা ছিল না। রাজাকারদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত থাকলেও বেশিরভাগ সময় কাটাতেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা অনেক চিকিৎসক ভারতে গিয়ে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সব চিকিৎসকের অনেকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। আবার কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসা করেছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাসকৃত চিকিসকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন- শিশির মজুমদার, ডা. সরওয়ার আলী, অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ডা. মাকসুদা নার্গিস, ডা. কাজী তামান্না, ডা. ফোজিয়া মোসলেম, ডা. সমূর কুমার শর্মা প্রমুখ (অনেকের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি)। দেশের ভেতর থেকে অসংখ্য চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে অনেককে জীবন দিতে হয়েছে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তৎকালীন ছাত্র ও চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক তৎকালীন ছাত্রছাত্রী এবং এই কলেজে কর্মরত চিকিৎসকদের তালিকা আমাদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ:
নব্বই’র স্বৈরাচারবিরোধী গণ আন্দোলনও এই মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও রাজপথের সহযোদ্ধা ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনের রক্তে পেয়েছিল নতুন মাত্রা। এ দেশের গণ মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে রয়েছে আমাদের সাহসী উত্তরাধিকার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের চিকিৎসা সেবায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ তার সংগ্রামী ঐতিহ্য বজায় রেখেছে এই দেশের গণমানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দুয়ার থেকে কোন রোগীকে বিনাচিকিৎসায় ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই । করোনা যুদ্ধে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সন্তানরা এগিয়ে এসেছে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে, তাঁদের আত্মত্যাগের এই ঋণ চিরস্মরণীয়।

অথচ মেলেনি স্বীকৃতি:
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এখনো পর্যন্ত কোন জাতীয় স্বীকৃতি পায়নি। তবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনের নিয়মকানুন অনেক জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। তাই জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি বা পুরস্কারের জন্য কখনো আবেদন করা হয় না । আমরা অনেকেই বিভিন্ন সময় কলেজ দিবসকে উপলক্ষ করে লেখালেখি বা বক্তব্যে এ বিষয়ে বলেছি। তবে ২০২১ সালে “ চিকিৎসা” খাতে “ঢাকা মেডিকেল কলেজ” কে “স্বাধীনতা পদক” দেবার জন্য আবেদন করেছি। ইতোমধ্যে যথাযথভাবে পূরণ করে ৮৫ পৃষ্ঠার আবেদন পত্র মোট ৩০ কপি করে জমা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বললে যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দেয়া যাবে না, তেমনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের নামটিও অবশ্য-স্মরণীয়। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যালামনি ট্রাস্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়