শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ০৯:৫১ সকাল
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ০৯:৫১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দীপক চৌধুরী: সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন শুদ্ধ চিত্তের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদের খুবই দরকার ছিল এখন

দীপক চৌধুরী: পাঁচ দশকে আটবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন প্রবীণ রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাজনীতির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই নিরন্ন ও মানুষের স্বার্থে পালন করেছেন নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন তিনি। সুরঞ্জিত ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখন আমাদের মধ্যে নেই। আজ এই সিংহ পুরুষের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। এ দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম সুরঞ্জিতের। তার বাবা চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স গ্র্যাজুয়েট ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেন। দেশের এই প্রবীণ রাজনীতিক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

সত্তরের ঐতিহাসিক প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সময়ও ন্যাপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বামপন্থী সুরঞ্জিত ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একবারই মন্ত্রী হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে সেই ২০১২ সালে রেলপথ মন্ত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। এটা ছিল তাঁর প্রতি বিরাট ষড়যন্ত্র। রেলের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। অবশেষে নানা বিতর্কের পর নিজ থেকেই মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর যে হৃদয়ের টান ছিল তা বোঝা যায় এভাবে যে, অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি বিয়ে, জন্মদিন, মৃত্যুদিবস, পূজাসহ সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকতেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন শুদ্ধ চিত্তের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট হ্যাজ লস্ট এ গ্রেট পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি আপাদমস্তক পলিটিশিয়ান ছিলেন।’ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও আটবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা বলে শেষ করার নয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-ঘাতক ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবিদ ও নেতা-কর্মীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল বিশেষ মর্যাদার। প্রকৃত অর্থেই আপোসহীন রাজনীতিবিদ ছিলেন এ নেতা। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো স্পষ্টবাদী রাজনীতিক সুরঞ্জিত অপ্রত্যাশিতভাবে রেলপথমন্ত্রী থেকে ইস্তফা দেয়ার পরও রাজনীতির ঘরে-বাইরে মাথা তুলেই কথা বলেছেন সব স্থানে। তাঁর সমালোচনামুখর কণ্ঠে আওয়ামী লীগের কেউ মনোক্ষুণ্ন হলেন কিনা, প্রভাবশালী কেউ ক্ষুব্ধ হলেন কী- তাতে কিছু আসত-যেত না রাজনীতির এ সিংহ পুরুষের। সত্য কথা বলে দলের ভেতর কারও কারও সমালোচনার মুখে পড়েছেন, দলের বাইরে তীব্র চাপের মুখে পড়েছেন, তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হলেও থোড়াই কেয়ার করতেন সুরঞ্জিত। চলমান গণতন্ত্রে তৃপ্ত ছিলেন না তিনি। তাই কঠোর উচ্চারণ করে বলতেন, ‘গণতন্ত্রে সহনশীলতা চাই।’ দরাজকণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অধম বলিয়া তুমি উত্তম হইবে না কেন?’ নেতাকর্মী মহল তো বটেই, সকল মহলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কখনও হয়ে যেতেন কঠোর আবার তুলার মতো নরমও কখনো। সুনামগঞ্জের নিতান্ত পল্লী-অধ্যুষিত দিরাই ও শাল্লা উপজেলার মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ও আদর্শ পুরুষ হিসেবে খ্যাত এ রাজনীতিক চলে যাওয়ার পর মানুষের মধ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল।

তাঁর মৃত্যুর পর প্রাণহীন দেহের সঙ্গী ছিলাম আমিও। শেষকৃত্য হয় তাঁর জন্মমাটি দিরাইয়ে। সেদিন ছিল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেয়া হয়। তৃণমূলের নেতাকর্মীর কাছে রাজনৈতিক গুণ ও ব্যক্তিগত কর্মে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার পাত্র। তাদের যত সমস্যা ও অভিযোগ থাকুক না কোনো- সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জানাতেই হবে এটা ছিল তাঁদের একটা প্রতিজ্ঞা যেনো। বিচার পাওয়া বা সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়া বড় কথা নয়। তাঁকে বলা হয়েছে, তাকে জানানো হয়েছে এটাই ছিল স্থানীয় সাধারণ মানুষের কাছে বড় পাওয়া। একবার যে তাঁর সাহচর্যে গেছে, সে-ই তাঁর ভক্ত হয়ে যেতো।

স্থানীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতা সুরঞ্জিতের রয়েছে নানা অভিজ্ঞতা। এক সময় নাটক করতেন, অভিনয়গুণ ছিল চমৎকার। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘দুখু সেন’ নামে পরিচিত। কারণ, খুব ছোট অবস্থায় তিনি মাকে হারিয়েছিলেন।

১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে নির্বাচন করে প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হওয়ার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সবার মনোযোগ কাড়েন। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ প্রায় সব আসনে বিজয়ী হয়। এরপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মীর শওকত আলী (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) সেক্টর কমান্ডার, সুরঞ্জিত সাব-সেক্টর কমান্ডার ও মেজর জগজিৎ সিং ভাট উপদেষ্টা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিলেট-সুনামগঞ্জের তামাবিল, ভোলাগঞ্জ, বাঁশতলা, বালাট ও টেকেরঘাট নিয়ে ছিল ৫ নম্বর সেক্টর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ তিনি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার চমৎকার এক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। নির্দিষ্ট কোন জায়গা নয়, সর্বত্রই। সেটা পার্লামেন্টই হোক, রাজনীতির ময়দানই হোক। কেবল ভাটি বাংলায় কেনো, সব জায়গায়ই দেখা গেছে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য সব শ্রেণীর লোক ভিড় জমাতেন। তিনি যখন সংবিধান কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ‘আইনী’ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে কথা বলতেন, তখন সব সদস্য তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। রাজনীতির কঠিন ভাষায় আক্রমণ করতেন প্রতিপক্ষ সংসদ সদস্যকে। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে পারতেন না, কারণ তারাই দেখা যেতো ভুল। এখন আল-জাজিরার বিভ্রান্তকর রিপোর্ট বা জামায়াতের ষড়যন্ত্র নিয়ে তাঁর চমৎকার ও গ্রহণযোগ্য কথা শোনা যেতো। রাজনীতিতে বাকপটু, রসিক ও দক্ষ সাংসদ হিসেবে সুনামের অধিকারী ছিলেন তিনি। সুরঞ্জিত সেনের সকল প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর কর্মকান্ডের একান্ত সহযোগী ছিলেন তাঁর স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্ত। এখন তিনি সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা আসনের বর্তমান জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত সাংসদ।

লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়