ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন: মানবকল্যাণে এবং যে কোনো প্রয়োজনে শান্তিপূর্ণ সমাধানকে অনেকে দক্ষতা বলে অভিহিত করেছেন। ইংরেজিতে Time management, Expertise বা Skill Management-কে অনেকে দক্ষতা বলেন। আরবিতে এর সংজ্ঞা বা উদাহরণে ব্যতিক্রম নেই। তবে আধুনিক আরবি ভাষায় ইদারাতুল মাহারাত শব্দটি বেশি ব্যবহূত হয়। কোরআনের কোনো সুরা বা আয়াত অধ্যয়ন করলে, হাদিসে রসুল বিশ্লেষণ করলে প্রতিটি অক্ষর বা বাক্যে দক্ষ মনুষ্যত্বের ঘ্রাণ পাওয় যায়। কীভাবে রসুল (স) তার শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করেছেন; মক্কার উচ্ছৃঙ্খল জীবন, যৌন উন্মাদনা ও কাজের অশ্লীল আহ্বান বা পেশিশক্তির উন্মত্ততাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং ক্ষুদ্র হানিফ সম্প্রদায়ের নিভৃত জীবন, মানবতাবাদী চলাফেরার সাবলীলতাকে তিনি নিজের জীবনে নিজের দক্ষতায় প্রয়োগ করেছেন। অনিরাপদ মক্কার নিরাপত্তার দায়িত্ব, হাজরে আসওয়াদের বিষয়ে দীর্ঘকালীন বিরোধের সমাধান, বিবি খাদিজার ব্যবসার অর্থের যথার্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। রিসালাতের দায়িত্ব রসুল মুহাম্মদ (স)কে আরো সংবেদনশীল করে তোলে। ভয়ার্ত রসুলকে সান্ত্বনা দিতে খাদিজার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘আপনার ভয় নেই। আল্লাহ আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো অসহায়ের বন্ধু, ছিন্নমূলের সাহায্যকারী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী। মহান রিসালাতের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা যথার্থ ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন।’ এই রিসালাতের মূল স্পিরিট হলো দাওয়াহ। দাওয়াহ অর্থ আহ্বান। সত্যের পথে আহ্বান। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত যেখানে মূল প্রতিপাদ্য। চূড়ান্ত মিশন তার সালাম বা শান্তি। অর্থাত্ ইসলাম। এজন্য ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনবিধান বলা হয়, যেখানে দক্ষতা ও দাওয়াহর সমন্বয়ে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ ও বিশ্বের স্বপ্নবুনন হয় প্রতিনিয়ত। রাব্বুল ইজ্জতের করুণায় মুহাম্মদ (স) ছিলেন প্রকৃত ড্রিমার বা স্বপ্ন বুননকারী।
রসুল (স)-এর দাওয়াহ ম্যানেজমেন্ট ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, তার অর্জিত দক্ষতা দাওয়াহ ম্যানেজমেন্টে ব্যাপক অবদান রেখেছে। মক্কার সংখ্যালঘু জিন্দেগি, বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সঙ্গে আচার-আচরণ, মদিনায় হিজরত, উন্নততর জিন্দেগির সূচনা এবং এর সমৃদ্ধিতে রসুল (স)-এর দক্ষতা ও হিকমাহ প্রমাণিত। হিকমাহ হলো দাওয়াহর দক্ষতা বা দাওয়াহ ম্যানেজমেন্ট। সুরা আন-নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো।’ দক্ষতার সঙ্গে দাওয়াহ ম্যানেজমেন্ট দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার পূর্বশর্ত। রসুল (স)-এর জিন্দেগি আমাদের সামনে এর বড় উদাহরণ। সাহাবি ও তাবেয়িদের জিন্দেগিতে আমরা সফলতার সোনালি ঐতিহ্য খুঁজে পাই। দক্ষতার সঙ্গে দাওয়াহ ম্যানেজমেন্ট দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার চাবিকাঠি। এর ব্যতিক্রম মানে রসুল (স)-এর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুতি। সুতরাং মুসলমানরা যদি দিন ছেড়ে বৈশ্বিক সমৃদ্ধিতে ঝুঁকে পড়ে, এটা যেমন বিচ্যুতি তেমনি ধর্মের নামে, দিনি শিক্ষার নামে, দায়ির (আহ্বানকারী) নামে অদক্ষ জনশক্তি তৈরি দাওয়াহর মূল পথ থেকে বিচ্যুতি। বলা বাহুল্য, বর্তমানে মুসলমানদের দুর্দশার জন্য উল্লিখিত দুই দলই সমানভাবে দায়ী। এককভাবে জাগতিক সমৃদ্ধবাদীদের (সেক্যুলার অর্থে) দায়ী করলে ভুল হবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত উভয় সংকট ও বিভ্রান্তি নিরসনে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে চিন্তাশীল ইসলামিক পণ্ডিতগণ দাওয়াহ বিজ্ঞানকে একাডেমিক উচ্চতায় নিয়ে আসেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন দাওয়াহর প্রকৃত অর্থ মুসলমানদের হূদয়ে প্রোথিত করতে পারলে উভয় সংকটের নিরসন সম্ভব। সারা বিশ্বে দাওয়াহ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আমরা শামিল হতে পেরেছি তাদের অদম্য প্রচেষ্টার কারণেই। দায়িগণকে সমাজের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দক্ষতা ও ইলমের সমন্বিত দায়ি ইল্লাল্লাহর হাতে ইসলাম, ইসলামি দাওয়াহ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র অনেকের চেয়ে বেশি নিরাপদ।
লেখক :অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও ইন্টারফেইথ স্পেশালিস্ট