শিরোনাম
◈ বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে ইথানল নিতে পারে, যা তেলের চেয়ে অনেক সস্তা: রাষ্ট্রদূত ◈ যুক্তরাষ্ট্র সরে এলে বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে কে: বাইডেন ◈ মিয়ানমার সেনাসহ ২৮৮ জনকে ফেরত পাঠালো বিজিবি ◈ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির ৬৪ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ◈ বর্ধিত ভাড়ায় ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু ◈ বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ◈ আরও তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক ◈ সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ ◈ তাপপ্রবাহে উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা,  বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ ইউনিসেফের ◈ মন্ত্রী ও এমপিদের নিকটাত্মীয়রা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ওবায়দুল কাদের 

প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারী, ২০২১, ০৯:৫০ সকাল
আপডেট : ১০ জানুয়ারী, ২০২১, ০৯:৫০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এম. নজরুল ইসলাম: পিতা যেদিন ফিরে এলেন

এম. নজরুল ইসলাম: কেমন ছিলো সেই দিনটি, যেদিন ফিরলেন পিতা মুক্ত স্বদেশে, বিজয়ী বীরের বেশে? সেদিন আকাশে যে সূর্য উঠেছিলো, সেই সূর্য কি জানতো যে এক মহান পুরুষ ওই আলো গায়ে মেখে বিজয়ীর বেশে নিজের দেশে ফিরবেন, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে? ফিরলেন তিনি, বাঙালির ভালোবাসা ছুঁয়ে। বাঙালি জাতির হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরলেন সেই মহাপুরুষ, যার জন্য অপেক্ষায় ছিলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে একটি পাকিস্তানী বোয়িং ৭০৭-এ করে লন্ডনে পৌঁছেছিলেন ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ছ’টায়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডন থেকে সরাসরি দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে (বর্তমান ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) বঙ্গবন্ধু যখন অবতরণ করেন তখন স্থানীয় সময় সকাল আটটা বেজে দশ মিনিট। দিল্লীতে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। অভ্যর্থনা পর্ব শেষে সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। দিল্লী থেকে তিনি আসেন তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ১০ জানুয়ারি। বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২ সালের এই দিনে দেশে ফিরে আসেন বাঙালি জাতির জনক, বাংলাদেশের মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল ধারার প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে চূর্ণ হয়ে যায় এই উপমহাদেশের যুগ যুগান্তরের চিন্তার অস্থিরতা ও মানসিক অচলায়তন। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষ যেমন ফিরে পায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা, তেমনি তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির আশা ও আকাঙ্খার প্রতীক। একই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অন্ধকারের শক্তির সর্বনাশের সূচনাও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে। কেমন ছিলো সেই দিনটি? কেমন ছিলো সেদিনের সেই অপরাহ্ন?

সেদিন বাংলাদেশ বেতার থেকে অনবরত ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দরে অপেক্ষমান জনতা। এক একজনের চোখেমুখে অন্যরকম উত্তেজনা। নেতা আসছেন। আসছেন প্রিয় পিতা। পাকিস্তানের কারাগারের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশের মাটিতে আসছেন সেই মহামানব, যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবীত করেছিলেন। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি বাংলার মাটি স্পর্শ করে বিকাল ৩টায়। পিতা দৃশ্যমান হন। সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ, প্রিন্স কোট আর উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। চেহারায় কি একটু ক্লান্তির ছাপ? হবে হয়তো। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘদিন থাকা। তারপর পথের ক্লান্তি তো আছেই। বিমানের সিঁড়িতে দেখা যায় তাকে। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বলতে হয়, ‘অমনি পলকে দারুণ ঝলকে হৃদয়ে লাগিল দোলা। জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।’ একত্রিশ বার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের উল্লাস। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করল তার প্রিয় স্বদেশভূমি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রিয় দেশের বাতাস নিলেন বুক ভরে। স্পর্শ করলেন এই দেশের মাটি। প্রিয় আলো তাকে ছুঁয়ে দিলো। নাম না জানা কোনো পাখি কি দূরে কোথাও গান গেয়ে উঠেছিলো? জানা যায়নি। সেদিনের সেই অপরাহ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটি ছিলো এরকম, ‘ঢাকায় আজ জনতা তাকে এক বিজয়ী বীরের সংবর্ধনা দেয়। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় পৌঁছান। অত্যন্ত ক্লান্ত শেখ মুজিব তার ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, পৃথিবীর কোনো জাতিকেই স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এতো ত্যাগ স¡ীকার করতে হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতরকার সমস্ত সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সমস্ত দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘের সদস্য পদ পাবে। শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। তিনি তার ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন। তিনি আশা করেন, অবশ্যই এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হবে। তিনি বলেন, বাঙালিরা যারা দালালী, বেঈমানী করেছে এমনকি যারা তার প্রহসনমূলক বিচারে সরকারি পক্ষ নিয়েছিল তাদের সবার বিচার হবে। তবে আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নেবেন না।

ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমান মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো উত্তাল জনতা বিমানটিকে ঘিরে ফেলে। তার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাকে সংবর্ধনা জানান, ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার, সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কূটনীতিক প্রতিনিধিরা সংবর্ধনা জানান। জনতার ভিড়ে বেগম মুজিব ও তার দুই ছেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। কিন্তু শেখ মুজিব সোজাসুজি একটি খোলা ট্রাকে রমনা রেসকোর্সে যান।’ একই দিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘শেখ মুজিব যখন বিমানবন্দর থেকে ধীরে ধীরে জনতার ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিলেন, তখন জনতা তার ওপর ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করছিল এবং তালে তালে শেখ মুজিব জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলে। হাজার হাজার জনতা স্লোগান দেয়, বিশ্বে এলো নতুন দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, বিশে¡ এলো নতুন বাদ মুজিববাদ মুজিববাদ। অনেকে তাকে স্পর্শ করার জন্য পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে কাছে আসার চেষ্টা করে। বস্তুত শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকেরই প্রিয়।’

সেদিন রেসকোর্স ময়দানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা জানেন, বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তার দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিশ¡কবি, তুমি বলেছিলে : সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি... বিশ¡কবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। আমার বঙালি আজ মানুষ হয়েছে। ঢাকা রমনা রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ বাঙালির সামনে শেখ মুজিবুর রহমান কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে।’ এই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবসময় জনগণ তার প্রথম চাওয়া ও পাওয়া। ৯ মাস ১৬ দিন কারাবাস শেষে যেদিন দেশে ফিরলেন তিনি, সেদিন প্রথম গেলেন জনগণের কাছে। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ কি তার মনে পড়েনি? মনে পড়েনি সন্তানদের কথা? বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা, বৃদ্ধা মা। কাউকে কি মনে পড়েনি তার? পড়েছে নিশ্চয়। কিন্তু জনগণের নেতা জনগণের কাছেই আগে ফিরেছেন। অপরাহ্নে বিমানবন্দরে নামার পর তিনি গেলেন রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে জনগণ অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। এরপর ফিরলেন, সেই বাড়িতে, যে বাড়িতে তার পরিবারকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিলো। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে। সে বাড়িতে তখন নতুন আর এক অতিথির আগমন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার ছেলে জয়। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ফিরলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার রিপোর্টে তার বাড়ি ফেরার সেই দৃশ্যের বর্ননা আছে এভাবে, ‘বিশাল জনসভা শেষে ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে একটি গৃহে ঘটে বর্ণনাতীত এক আবেগপ্রবণ পুনর্মিলন। বন্ধুদের শুভেচ্ছা সূচক ফুলের পাপড়িতে শোভিত শেখ মুজিব তার দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। ঘটনা এর চেয়েও এগিয়ে যায় যখন শেখ মুজিব তার ৯০ বছরের পিতার পা স্পর্শ করে ৮০ বছরের মাকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন।’ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেও এ দেশের কিছু মানুষের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই জীবন দিতে হয়েছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই মহান নেতাকে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার নীতি ও আদর্শ রয়ে গেছে। বাঙালি জাতি বহন করছে তার উত্তরাধিকার। বহন করবে। যতোদিন বাংলাদেশ আছে, আছে বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধুর উত্তারাধিকারও ততোদিন থাকবে।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়