মাছুম বিল্লাহ: [২] ভারতের দৈনিক যুগশঙ্খে মঙ্গলবার শিতাংশু গুহের এক কলামে এ কথা লেখা হয়েছে। যুগশঙ্খের কলামটি হবহু আমাদের সময় ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ চীনকে পছন্দ করে? কথাটা রুঢ় সত্য। চীন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই কৃতিত্ব চীনপন্থী কমিউনিস্টদের নয়, বরং ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের। চীনপন্থী কমিউনিস্টরা প্রায় সবাই সাম্প্রদায়িক, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়। এভাবেও বলা যায়, চীনপন্থী কমিউনিষ্ট এবং ইসলামপন্থী মৌলবাদ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
এক সময়ে আমরা শুনেছি ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান।’ যারা এ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, জানি না এখন তারা বলবেন কি না, ‘চীনের ভাইরাস (করোনা) আমাদের ভাইরাস। চীন প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক কূটনীতির কারণে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেনি বা সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। চীন অযথা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়াবেই বা কেন? বন্ধুর জন্য যুদ্ধে ঝঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস চীনের কই? আর পাকিস্তান তো বন্ধু নয়, ‘খয়ের খা’, ভূত্যের জন্য কেউ মরে নাকি? পৃথিবীতে ‘প্রভুভক্ত’ কুকুরের অনেক গল্প আছে, কিন্তু ‘ভৃত্যভক্ত’ প্রভুর আত্মত্যাগের কাহিনী তেমন নেই? বাংলাদেশের জাতিপুঞ্জের সমস্যা প্রাপ্তি ইস্যুতে চীন ‘ভেটো’ দিয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে ৩১ আগষ্ট, ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর।
রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, একথা সবার জানা। চীন তাই বাংলাদেশের মানুষের চীনপ্রীতির কারণ রাজনীতি নয়, বরং ‘ভারত-বিদ্বেষ’। যেহেতু চীন ভারতের শত্রু, তাই বাংলাদেশের বন্ধু। ভারত বিদ্বেষই বাংলাদেশের দেশপ্রেম! পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচের কথা আনছি না, চীনপ্রীতির ঘটনা থেকে ভারত-বিরোধিতার তীব্রতা বোঝা উচিত।
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, ৯৩ হাজার বন্দি পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনেছে, বঙ্গবন্ধুর এক কথায় সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে বা এমনি কত কী যতই বলুন না কেন, কিছু লাভ নেই, ভারত বাংলাদেশের মানুষের মন পাবে না। বাংলাদেশে একটি সংলাপ আছে, ‘দেহ পাবি মন পাবি না’।
বাংলাদেশ সরকার (দেহ) ভারতের বন্ধু হতে পারে, কিন্তু জনগণ (মন) বিপক্ষে। অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান জনগণের সংখ্যাটা ১০০ শতাংশ হয়তো নয়, তা ঠিক। কিন্তু অংকটি বিশাল। ভারত যতই গরু, পেঁয়াজ সরবরাহ করুক না কেন, কাজ হবে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষ বাঙালি হননি, পাকিস্তানিই রয়ে গিয়েছেন। তাই পাকিস্তান ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ, ভারত বন্ধুপ্রতিম। ভাতৃপ্রতিম হচ্ছে ভাইয়ের মতো। ভাই বেশি প্রিয় না বন্ধু? ক’দিন আগে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য একটি সুন্দর কথা বলেছেন। সেটি হচ্ছে. ‘ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু, আর চীন বন্ধু।’ এটি তো রাষ্ট্র পর্যায়ের কথা। দুই দেশ তাদের প্রয়োজনমতো কূটনৈতিক ভাষায় কথা বলবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমি বলেছিলাম ‘আমজনতা’র কথা। বাংলাদেশিদের ভারত বিদ্বেষ ধর্মীয় চেতনা থেকে উদ্ভূত।
ঠিক একই কারণে বাংলাদেশের মানুষ কতটা বাঙালি, তা বলা মুশকিল। পুরোপুরি বাঙালি নয়, হয়তো ‘বাঙালি মুসলমান। ধর্ম সংস্কৃতির একটি অংশ। কিন্তু ধর্ম যেখানে সংস্কৃতি থেকে বড় হয়ে যায় অথবা ‘পরকাল’ ইহকাল থেকে মোক্ষ হয়ে যায়, সেখানে আরবীয় সংস্কৃতি ঢুকতে বাধ্য অথবা মরু সংস্কৃতি ঢুকলে এমনি হয়। বাংলাদেশে এখন বাংলা থেকে আরবির কদর বেশি। ষাটের দশকে আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি উদ্যোগ ছিল। সেটি যারা ভণ্ডুল করেছেন, তাদের উত্তরসুরীরা এখন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ওয়াজ শুনে ঘুমাতে যায়। কথাবার্তা, চলন-বলন বইপুস্তক সর্বত্র একই অবস্থা।
বাহাত্তরে বাংলাদেশে রব উঠেছিল, ‘ঢাকা হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির’ কেন্দ্রবিন্দু। এখন আর একথা কেউ বলে না। ছবি বিশ্বাসের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, ‘অভাব জানালা দিয়ে প্রবেশ করলে ভালোবাসা দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়’ মনে আছে নিশ্চয়? তেমনি মরু সংস্কৃতি দরজা দিয়ে ঢুকলে বঙ্গ সংস্কৃতি জানালা দিয়ে পালাবে বটে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক দৈন্য প্রকট, ভাস্কর্য ভাঙ্গা এর প্রমাণ। চীনে কিন্তু ভাস্কর্য আছে। চীন মুসলমানদের চরম অত্যাচার করছে, শুয়োর খাওয়াচ্ছে, মসজিদ ভেঙ্গে দিচ্ছে, মুমিন মুসলমান টু শব্দ করছেন না। এর ছিটেফোঁটা ভারতে হলে টের পেতেন তাদের দেশপ্রেম। এজন্যই বলছিলাম, ভারত-বিদ্বেষই বাংলাদেশে দেশপ্রেম।
আপনার মতামত লিখুন :