শিরোনাম
◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ০৮:৩৩ সকাল
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ০৮:৩৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সক্রিয় গ্রাম আদালতে গ্রামের সমস্যা গ্রামেই শেষ, মামলার চাপ কমবে আদালতে

নিউজ ডেস্ক : সক্রিয় করা হচ্ছে গ্রাম আদালত। আদালতগুলোতে মামলার চাপ কমাতে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য বর্তমান আইন সংস্কার করা হবে। সীমিত আকারে চালু থাকা এই আদালতের কার্যক্রম শুরু করা হবে দেশের সকল ইউনিয়নে। একই সঙ্গে গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থাও হবে শক্তিশালী। ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদে থানা বা আদালতে না গিয়ে গ্রাম আদালতেই সমাধান করা হবে। নাগরিক জীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এই উদ্যোগ অনেকটাই সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনকণ্ঠকে

বর্তমানে সীমিত পরিসরে চলছে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম। গ্রাম আদালত স্থাপনে প্রথমে ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই আইন আর কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালে পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই আদালতের কার্যক্রম চালু করে। পরে ২০১৩ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। পুরনো আইনটি সংস্কারের মাধ্যমে সময়োপযোগী করে নতুন রূপে প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্থানীয় সরকারের বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে পুরনো আইনের অসঙ্গতি খুঁজে বের করা এবং গ্রাম আদালতকে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু হয়েছে। নামমাত্র নয়, এই আদালতের কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি।

প্রথম আইনে গ্রামীণ আদালতের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তেমন বিধিবিধান ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এই আইন কার্যকর হয়নি। নাগরিকগণ বাধ্য হয়েই গ্রাম্য মাতাবরদের ওপর নির্ভর করে তাদের ছোটখাটো বিচার সালিশ সম্পন্ন করে আসছেন। সমাজে অন্যায় বিচার-সালিশের কারণে নানা রকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাম আদালত কার্যকর না থাকায় নাগরিকরা থানা বা আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন। মামলাজট সৃষ্টি হয় আদালতে। ছোটখাটো ঝগড়াগুলোর কারণে সৃষ্ট মামলাজটে গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিলম্বিত হচ্ছে বিচার কাজ। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নাগরিক জী নে। এসব কারণে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম ব্যাপক আকারে শুরু করা হচ্ছে।

পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের পর গ্রাম আদালত সক্রিয় করতে ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ২০০৯ সালে ‘এক্টিভেটিং ভিলেজ কোটর্’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৮০ কোটি টাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ও ইউএনডিপির এবং বাকি অর্থ সরকারের। প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদালতের এজলাস তৈরিতে প্রকল্পের বাইরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় ২৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বর্তমানে দেশের ২৭ টি জেলার ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৮০ টি ইউনিয়ন পরিষদে কাজ করছে। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় সেখানকার স্থানীয় আইনে বিচার সালিশ ব্যবস্থা কার্যকর থাকায় গ্রাম আদালত কার্যক্রম এতদিন বন্ধ ছিল। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে গ্রাম আদালত চালু করার জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে পার্বত্য এলাকার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ চলছে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। মূলত দেশের সকল ইউনিয়নে কিভাবে গ্রাম আদালত কাজ করতে পারে, আদালতের চলমান সমস্যা কি কি তা নিরূপণ করে সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

বর্তমান আইনে এই আদালতে কোন নাগরিক বিচারপ্রার্থী হলে সিভিল মামলার জন্য ২০ টাকা ও ক্রিমিনাল মামলার জন্য ১০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদনে সাক্ষী হিসেবে স্থানীয় একজন ও ইউপি মেম্বারকে রাখতে হবে। এর পর চেয়ারম্যানের নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বাদী-বিবাদীকে নির্দিষ্ট তারিখে ইউনিয়ন পরিষদে হাজির হতে চিঠি দেয়া হবে। যা পৌঁছে দেবে গ্রাম পুলিশ। অপরদিকে বিবাদীকেও একজন মেম্বার ও একজন প্রত্যক্ষদর্শী বা গণ্যমান্য সাক্ষীকে উপস্থিত করতে হবে। বর্তমান নিয়মানুযায়ী এ আদালতের পেশকারের দায়িত্ব পালন করবেন ইউনিয়ন পরিষদের হিসাবরক্ষক কাম কম্পিউটার অপারেটর। উভয়পক্ষের মোট ৪ জন ও চেয়ারম্যানকে নিয়ে আদালতে বিচার কার্য পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে কোন পক্ষ আপোস করতে চাইলে তা একদিনেই আদালতের মাধ্যমে তার কার্যক্রম শেষ করা হবে। তবে এ নিয়ে কেউ আপোস করতে না চাইলে শুনানির জন্য দিন বা তারিখ ধার্য করা হবে ও বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন চেয়ারম্যান। বিচারের রায় উভয়পক্ষ মানতে বাধ্য থাকবে। মামলা চলাকালীন গ্রাম পুলিশগণ আদালতে উপস্থিত থাকবেন। রায় অনুযায়ী ধার্য যে কোন জরিমানা দিতে না চাইলে প্রয়োজনে তার জমি ক্রোক করার বিধান রয়েছে। আইনে বলা হয়, গ্রাম আদালতে বিচার্য কোন বিষয় থানায় নেয়া যাবে না। একই সঙ্গে অন্য কোন আদালতে এসব বিষয়ে বিচার কার্য পরিচালনা করা যাবে না বা আপীল পর্যন্ত করা যাবে না। ফলে গ্রাম আদালতই শেষ ঠিকানা হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রকল্প শুরুর পর গ্রাম আদালতে বিচার্য বিষয়ে এ পর্যন্ত চেয়ারম্যান, মেম্বার, সচিব ও পেশকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য হিসাবরক্ষক কাম কম্পিউটার অপারেটরদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে কোন থানায় যাতে ছোটখাটো বিষয়ে মামলা না নিয়ে গ্রাম আদালতে পাঠানো হয় সেজন্য স্থানীয় প্রতিটি থানাকে অবহিত করা হয়েছে। এই আইনে দেশের সকল ইউনিয়নে গ্রাম আদালত কার্যকর করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

স্থাানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গ্রাম আদালতকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার কোন বিকল্প নেই। গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করতে পারলে জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। গ্রামাঞ্চলে অনেক ছোট ছোট এবং খুব সামান্য বিষয় নিয়ে মানুষ নানারকম বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয়ভাবে এসব বিবাদ মীমাংসা করতে না পারায় তারা কোর্টে চলে যান। এতে একদিকে যেমন আদালতে মামলার জট তৈরি হয়, অন্যদিকে ভুক্তভোগীদের সময় ও অর্থের অপচয় হওয়ার পাশাপাশি তাদের মামলার রায় পেতে অনেক দেরি হয়। এছাড়া এক ধরনের অসাধু ব্যক্তি বিবাদ মীমাংসা করে দেয়ার নামে উভয়পক্ষের কাছ থেকে টাকাপয়সা আদায় করেন।

তিনি বলেন, দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করায় বর্তমানে গ্রাম আদালতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম আদালত পরিচালন প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে এর আইন আরও যুগোপযোগী করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গ্রাম আদালতের আইনী কাঠামোতে সংস্কার করা হবে। সারাবিশ্বে সময়, পরিস্থিতি ও মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আইনের পরিবর্তন করা হয়। গ্রাম আদালত আইনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আইন যুগোপযোগী করার জন্য সরকার কাজ করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজির সকল টার্গেট পূরণ করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে বৈষম্য নিরসনে সরকার কাজ করছে। গ্রাম আদালত সক্রিয় করার কার্যক্রম পরিচালনায় একদশক জুড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকারের পাশে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় গ্রাম আদালত আরও কার্যকর করা সম্ভব হবে। এজন্য মন্ত্রী সমাজের সকল স্তরের নাগরিকের সহযোগিতা কামনা করেন।

জানতে চাইলে স্থাানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে গ্রাম আদালত কার্যক্রমের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে নিজের এলাকাতেই গ্রামে বসবাসকারীদের ছোটখাটো বিচার ব্যবস্থার ও নানা সমস্যার সমাধানের পথ খুলেছে।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বলেন, আইনের মাধ্যমে আমরা গ্রাম আদালতে ছোটখাটো ঝগড়া বা সমস্যা যাতে চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ শেষ করতে পারেন সেজন্য গত ১০ বছর যাবত কাজ করছি। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রাম আদালতে বিচার্য বিষয়ের সাড়ে নয় হাজারের বেশি মামলা ফিরিয়ে দিয়েছে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের বিচারকগণ। এসব মামলা গ্রাম আদালতে সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারকগণ। ফলে ধীরে ধীরে এ আদালতের প্রতি ঝুঁকছে নাগরিকগণ। এই ধারা অব্যাহত রাখতে দিনরাত কাজ করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সাল থেকে এ আদালতে মামলা দায়ের করে মোট ১৭২ কোটি টাকা বিবাদীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করা হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ আয়োজিত গ্রাম আদালতের আইনগত কাঠামো সংস্কার বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ে পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী তথা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, গ্রামের সমস্যা গ্রামেই শেষ করতে হবে এই লক্ষ্য সামনে রেখে ১৯৭৬ সালে প্রথম গ্রাম আদালত পদ্ধতি চালুর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে এটি আইনে পরিণত করে সরকার। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার বেশ কিছু সংশোধনী আনে। সর্বশেষ এ প্রকল্পের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নতুন সংশোধনী আনতে কাজ করছে সরকার। এ আদালত পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও জেলা আদালতে মামলার হার কমানো সম্ভব হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়