শিরোনাম
◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ০৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ০৭:৫৫ সকাল
আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ০৭:৫৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রভাষ আমিন: মামুনুল-ফয়জুল-বাবুনগরী গংয়ের অপরাধসমূহ

প্রভাষ আমিন: হঠাৎ করেই দেশের উগ্র মৌলবাদী শক্তি মাঠে নেমেছে। আপনার পছন্দ হোক আর না হোক, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এমনকি মৌলবাদী শক্তিও আইনের সীমায় থেকে তাদের প্রতিবাদ জানাতে পারে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই মতপ্রকাশের অধিকার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। রাজপথে গণতান্ত্রিক স্পেস নেই বললেই চলে। মামলা-হামলা-গুম-খুনে বিপর্যস্থ বিরোধী দলগুলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কণ্ঠ চেপে ধরেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও। এই নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যেই উগ্র মৌলবাদী শক্তিদের আস্ফালন একটু বিস্ময়করই বটে। যেখানে সাধারণ প্রতিবাদেও মানুষকে কারাগারে যেতে হয়, সরকার-বিরোধিতাকে গুলিয়ে ফেলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার সাথে, সেখানে দিনের পর দিন মৌলবাদীরা আইনবহির্ভূত, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউটিউবে তাদের সেই বক্তব্য বিভ্রান্ত করছে, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের।

আগেই বলেছি, আমি বিশ্বাস করি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। মতপ্রকাশের ব্যাপারে আমি সবসময় ভলতেয়ারপন্থি। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।’ আমি সবসময় মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। সবধরনের ভিন্নমতকে স্বাগত জানাই। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানেই কিন্তু যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকার নয়। বাংলাদেশের সংবিধানেও শর্তসাপেক্ষেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইলো। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইলো।’

এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ প্রাসঙ্গিক অনেক আইনে মতপ্রকাশের ব্যাপারে নানা বিধিনিষেধ আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহুল অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক-সমাজসহ সমাজের সুশীল অংশ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তবে ডিজিটাল প্লাটফর্মে একটা শৃঙ্খলা আনা দরকার। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি আইনও থাকা দরকার। কিন্তু সে আইনের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ-শঙ্কা আছে এবং বারবার সে শঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বাউল গানের পক্ষে কথা বলার অপরাধে শরিয়ত বাউল কারাগারে আছেন দীর্ঘদিন। আর পালাগানে অংশ নেয়ার দায়ে রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটি কমা কম দেয়ার অপরাধে রাজবাড়ির এক যুবককে কারাভোগ করতে হয়েছে। এই যখন দেশের অবস্থা, তখন ইসলামি মৌলবাদীরা দিনের পর দিন যা ইচ্ছা তাই বলার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। কীভাবে?

ইসলামী উগ্র মৌলবাদীরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে যা করছে, তা কোনোভাবেই মতপ্রকাশ নয়, প্রচলিত আইনেই অপরাধ। আর এ অপরাধ বুঝতে আপনাকে বিচারক বা আইনজ্ঞ হতে হবে না। এখনি ইউটিউবে গিয়ে কোনো একটি ওয়াজ শুনলে আপনিই বুঝবেন অপরাধটা কোথায়? আমি মোটেই ঢালাওভাবে ওয়াজের বিরোধিতা করছি না। আবহমানকাল ধরে ইসলামী আলেমরা শুক্রবারের খুতবায় বা মৌসুমী ওয়াজে ইসলামের নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ইসলামের পথে, কল্যাণের পথে মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছেন। সঠিক ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদেরকে অন্যায় থেকে, পাপ থেকে, মিথ্যা থেকে, দুর্নীতি থেকে দূরে রাখে। ওয়াজে যুগ যুগ ধরে এই মূল্যবোধেরই প্রচার হচ্ছে। কিন্তু উগ্র কিছু মৌলবাদী ওয়াজের সুযোগে ইসলামের অবমাননা করছে। কিছু ওয়াজ এতোটাই অশ্লীল, যা প্রকাশ্যে শোনাই যায় না। কিছু ওয়াজে নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে করে চাইলে প্রতিদিনই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কিন্তু এই বাংলায় শরিয়ত বাউল কারাগারে, রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও উগ্র ও অশ্লীল মৌলবাদীরা একধরনের ইনডেমনিটি সুবিধা ভোগ করে। গায়ে ইসলামী লেবাস থাকলেই তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, এমন একটা অলিখিত নিয়ম অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। চলতে চলতে তারা আজ আমাদের জাতিসত্তা, সংবিধান এবং জাতির জনকের ওপর আঘাত হানার স্পর্ধা দেখাতে পারছে।

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের নাটক-সিনেমায় স্বাধীনতাবিরোধী বা খারাপ মানুষের চরিত্র মানেই দেখানো হতো দাড়ি-টুপি-আলখাল্লা। আর এখন দাড়ি-টুপি-আলখাল্লা মানেই যেন সাত খুন মাফ। দুটির কোনোটাই ঠিক নয়। আইন সবার জন্যই সমান। কোনো একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে ঢালাওভাবে হেয় করাও যেমন অন্যায়, তেমনি তাদের ঢালাও ছাড় দেয়াও ঠিক নয়। এই ঢালাও ছাড়ের সুবাদেই তারা আজ মাঠে নেমেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

গত ১৩ নভেম্বর মামুনুল হক, আর সৈয়দ ফয়জুল করিমরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যা বলেছেন, যেভাবে জাতির জনকের ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছেন তা স্পষ্ট সংবিধানপরিপন্থী এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। পরে হেফাজতে ইসলামের জুনায়েদ বাবুনগরীও কণ্ঠ মিলিয়েছেন তাদের সাথে। জাতির জনকের অবমাননা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা না হয়, তাহলে তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলতে হবে। আর মামুনুল হক যে ভাষায় এবং ভঙ্গিতে কথা বলে, তা জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতা পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী তার এ ধরনের কথা বলার স্বাধীনতা নেই। মামুনুল হক ‘লাশের পর লাশ ফেলার’ হুমকি দেয়; বঙ্গভবন, গণভবন, সংসদ ভবন রক্তে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়; এসব প্রচলিত আইনেই ফৌজদারি অপরাধ। মামুনুল-ফয়জুল-বাবুনগরীরা না বলে অন্য কেউ এই কথাগুলো বললে তাকে অনেক আগেই গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলাই করা হয়নি। কিসের ভয়ে?

এসবই রাজনীতির অংশ। আমার দৃষ্টিতে মামুনুল হকের আরো একটি বড় অপরাধ আলোচনার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। মামুনুল হক এক ওয়াজে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কিভাবে কথা বলতেন, তা ব্যঙ্গ করে দেখিয়েছেন। এরচেয়ে বড় কথা, হযরত মুহাম্মদ (স.) কিভাবে কথা বলতেন তা এই মামুনুল হক জানলেন কোত্থেকে, দেখলো কিভাবে? বাংলাদেশের উগ্র মুসলমানদের মতো আমার ধর্মীয় অনুভূতি কথায় কথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। কিন্তু মামুনুল যেভাবে মহানবী (স.)- কে ব্যঙ্গ করেছেন, তা দেখে আমার এক ধরনের বিবমিষা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর এরচেয়ে বড় অবমাননা আমি আর কখনো দেখিনি। ফ্রান্সের কোথায় কী ছাপা হয়, তা না-দেখেই আমাদের লাখ লাখ মুসলমান নবী অবমাননার প্রতিবাদে মাঠে নেমে যায়। আর মামুনুলের মতো এমন জলজ্যান্ত অবমাননাকারী ‘বাংলাদেশে ইসলামের হেফাজতকারী’ হয়ে দাপটের সাথে ঘুরে বেরাচ্ছে।

আমি দাবি জানাচ্ছি, মামুনুল-ফয়জুল-বাবুনগরীর বিভিন্ন বক্তব্য পর্যালোচনা করে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অশ্লীলতা ছড়ানো এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের সব শক্তি তাদেরকে রাজপথে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবে। আর সরকার যেন আইনগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। একটি আইনি রাষ্ট্রে কারোই যা ইচ্ছা তাই বলার স্বাধীনতা নেই, থাকতে পারে না। সবাইকে সংবিধান, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়