শিরোনাম
◈ সয়াবিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ◈ কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকি, আইনের শাসনে জীবনযাপন করি: ড. ইউনূস ◈ মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ঢাকা ফিরছিলেন রফিক, পথে প্রাণ গেল সবার ◈ স্থায়ী জামিন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছি: ড. ইউনূসের আইনজীবী ◈ উপজেলার ভোটে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : ওবায়দুল কাদের  ◈ শ্রম আইন লঙ্ঘন: ড. ইউনূসসহ ৪ জনের জামিন ২৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি ◈ ময়মনসিংহে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ২৬ ◈ ফরিদপুরে বাস-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত বেড়ে ১৩  ◈ ইরানের হামলার জবাব দেবে ইসরায়েল: সেনাপ্রধান

প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ০২:৩৬ রাত
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ০২:৩৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এম. নজরুল ইসলাম: লক্ষ্য সরকার উৎখাত, উপলক্ষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য

এম. নজরুল ইসলাম: রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা প্রদান এবং স্থাপিত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ভয়ঙ্কর হুমকি দিয়েছে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। তারা যে ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিষোদগার করেছে তা যে রাষ্ট্রদ্রোহতুল্য অপরাধ, এটা সবাই স্বীকার করবেন। হঠাৎ সরব হয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন। তাদের দাবি, তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়, সব ধরনের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু কথাটা যে সর্বৈব মিথ্যা, তা প্রমাণ হয়েছে কুষ্টিয়ায়। সেখানে জাতির পিতার নির্মাণাধীন এক ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশবিশেষ শুক্রবার রাতের কোন এক সময় ভেঙে ফেলা হয়। কোন সংগঠনের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী না থাকলেও গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঢাকার বায়তুল মোকাররমের সামনে ভাস্কর্যবিরোধী মিছিলের চেষ্টা হয়েছে। এসব আদৌ শুভলক্ষণ নয়।

ভাস্কর্য কী? ভাস্কর্য হচ্ছে মানুষের চিন্তাশক্তির সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ। একটি দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির পরিচায় ফুটে ওঠে এর মধ্য দিয়ে। ইসলামের পুণ্যভূমি সৌদি আরবে রয়েছে উট, ঘোড়া, গাংচিলের ভাস্কর্য। রাজধানী জেদ্দার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য। প্রচুর ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য রয়েছে ইরাকে। সুন্নিপ্রধান সিরিয়ায় রয়েছে বীর মুসলিম সেনাপতি সালাদিন স্মরণে নির্মিত ‘স্ট্যাচু অব সালাদিন’। পুরো ইন্দোনেশিয়া জুড়ে রয়েছে প্রচুর ভাস্কর্য। ইরানের তেহরানের ফেরদৌসী স্কয়ারে আছে মহাকবি ফেরদৌসীর ভাস্কর্য, হামাদানে ইবনে সিনার ভাস্কর্য, তেহরানের লালেহ পার্কে ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য, কবি হাফিজের ভাস্কর্য, খোরাসানের মাসাদে নাদির শাহর ভাস্কর্য। ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি বা ইমাম খোমেনির একাধিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে ইরানে। পাকিস্তানের স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনের সামনে কৃষ্ণ­মূর্তি, লাহোরে বাদশাহী মসজিদের পার্শ্বে মেরি মাতার মূর্তি, পাঞ্জাবের জং শহরের রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়সওয়ারের মূর্তি, লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস প্রাঙ্গণের নানা ভাস্কর্য কি পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলেছে? মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সেদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট। মালয়েশিয়ার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো- বাতু কেভসের বিখ্যাত মুরুগান ভাস্কর্য, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার ভাস্কর্য এবং কনফুসিয়াসের ভাস্কর্য। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো বুর্জ আল খলিফার বিপরীতে সংস্থাপিত আরবীয় যুগলের ভাস্কর্র্য। দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের প্রতিমূর্তি হিসেবে সংস্থাপিত আছে কুকুরের ভাস্কর্য।

সারা তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য। সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ কাতারের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সেখানেও দেখা যায় ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন সব ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। কাতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো ‘হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড’।

অর্থাৎ, ভাস্কর্য স্থাপন করায় কোন মুসলিম দেশ ধর্মান্তরিত হয়ে যায়নি। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান কয়েকদিন আগে এক নিবন্ধে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। কয়েক বছর আগে তিনি তুরস্কের বিখ্যাত ব্লু মস্কে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখেছেন, ভেতরের দেয়ালে গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেলসহ সব ধর্মগ্রন্থ থেকে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কী বলা আছে তুর্কী ও ইংরেজী ভাষায় তা বড় বড় করে বর্ণনা করা আছে।

লন্ডনপ্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর সাম্প্রতিক এক কলামে লিখেছেন, ‘বাঙালীর স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার অবাধ বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা দ্বারা যখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, তখন আমদানি করা হয়েছে ধর্মান্ধতা। ... বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা এখন ধর্মান্ধদের মাঠে নামিয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ গত ৫০ বছর ধরে যে অর্জন করেছে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সহনশীল সমাজব্যবস্থা, উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা- সব কিছু ধ্বংস করে দেশটাকে আবার মধ্যযুগীয় অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

আসলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ওদের লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য সরকার উৎখাত। আর তাই, কোন একটা হুজুগ বাধাতে পারলেই ওরা খুশি। সবকিছুর মধ্যে ওরা সরকার পতনের স্বপ্ন দেখে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরই এই সরকারবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রের আভাস দেয়। আদর্শগত মতপার্থক্য থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনকে কবজায় নিতে মাঠে নামে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের সঙ্গী হয় রাজনৈতিক মাঠের সঙ্গী বিএনপি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে সবারই জানা, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে কবজায় নিয়েছে জামায়াত-বিএনপি। এখন তারাই এই গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে। ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’- বিএনপির স্বঘোষিত অভিভাবক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কয়েকদিন আগে বলেছেন, ‘একটু ধাক্কা দিলেই সরকার পড়ে যাবে’। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর ভাষায় ‘রাজনৈতিক এতিম’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সরকার হটাতে বিরোধীদের জোটবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছেন একই সময়ে।

অর্থাৎ, এদের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। কিন্তু সে লক্ষ্য কখনও বাস্তবায়িত হবে না, যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘...সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,/ যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;/ যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে/ পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে;’। তাই আর কোনো দ্বিধা নয়। রুখে দাঁড়াতে হবে। কবিগুরুর ভাষায় আবারও বলি, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই!’ আর হেলাফেলা করার সময় নেই। ‘দেখি কী হয়’ ভেবে সময়ক্ষেপণের দিনও শেষ। আলাপ-আলোচনার কথা বলে তলে তলে বাংলাদেশবিরোধী চক্র যুদ্ধে নেমে গেছে। উদাহরণ এখন কুষ্টিয়া। আগের রাতে ভাঙচুর করা ভাস্কর্যে গুলি করেছে শনিবার রাতে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আঘাত এসেছে সরাসরি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর গুলিবর্ষণ মানে বাঙালীর হৃদপিণ্ডে গুলি করা। যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী, বাংলাদেশবিরোধী চক্র। প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমেছে। বঙ্গবন্ধুর জম্নশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পদার্পণের সময়টিকেই বেছে নিয়েছে তারা। আর বসে থাকার কোন সময় নেই। ‘এ লড়াইয়ে জিততে হবে’- কোন বিকল্প নেই। এখন ‘ডাকিয়া বলিতে হবে-/ মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে।’

সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তফা ওসমান তুরান সাংবাদিকদের বলেছেন, তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং ঢাকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য নির্মাণ করবে তুরস্ক। শুধু তুরস্কে কেন? সারা বিশ্বে কেন নয়? সদাশয় সরকারের কাছে আমরা একটি আবেদন জানাতে চাই। বিদেশে বাংলাদেশের সব মিশনের সামনে সরকারী খরচে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক অনতিবিলম্বে। মুজিববর্ষে এই উদ্যোগটি নেয়া অতিজরুরী বলে আমরা মনে করি।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

nazrul@gmx.at

সূত্র : জনকণ্ঠ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়