কামরুল হাসান মামুন : সকালবেলা আমার এক প্রিয় ছাত্র আমেরিকা থেকে ফোন করেছে। সে ওখানে মাত্র কোর্স ওয়ার্ক শেষ করলো। তো কথা প্রসঙ্গে বলছিলো, ওখানে ক্লাস করে এক বছরে যা শিখেছে দেশে চার বছরেও তা শিখেনি। তো জিজ্ঞেস করলাম ওখানে বেশি শেখা হয় কেন? উত্তরে বললো, ওখানে পড়ানোর স্টাইল একটু ভিন্ন। তবে তার চেয়ে বড় কথা প্রশ্নের স্টাইলও ভিন্ন। আর পড়ানোর সময় কুইজ, ক্লাস পরীক্ষা ইত্যাদি লেগেই থাকে যেখানে কেবল প্রব্লেমই থাকে সাথে কিছু প্রশ্ন যার উত্তর খুবই কম কথায় দেওয়া সম্ভব।
এইবার আমি বললাম। তোমাদের ওখানের শিক্ষকরা কি ওই কুইজ আর ক্লাস টেস্টের খাতা দেখে? বললো না। তোমাদের ওখানের শিক্ষকদের কি ল্যাবে ৯ ঘণ্টা গরুর মতো খোটা গেড়ে বসিয়ে রাখে? বললো না। ওখানকার ছাত্ররা কি আবাসিক হলে নির্যাতিত হয়? বললো, না। ছাত্র শিক্ষক কি ফুল টাইম রাজনীতি করে? বললো, না। ওখানকার আবাসিক হলে কি ‘গণরুম’ আছে? বললো, না। শিক্ষকরা কি রাজনীতি, নির্বাচন আর পদপদবির জন্য দৌড়ান? বললো, না। ওখানে কি সরকারদলীয় ছাত্র বা শিক্ষক আর বিরোধী দলীয় ছাত্র বা শিক্ষকে ভাগ হয়ে থাকে? বললো, না। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বিভাগে কতোজন পোস্ট-ডক আছে? বললো, ২০-৩০ জন হবে। কতোজন পিএইচডি ছাত্র আছে? বললো, অনেক।
Exactly! এসবই পার্থক্য গড়ে দেয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয় গাছগাছালি ভরা ছবির মনোরম পরিবেশ। সেখানে ছাত্রছাত্রীরাদের আবাসিক হল হয় থ্রি-স্টার হোটেলের মতো। তারা উন্নত খাবার খায়। শিক্ষকরা থাকে পড়াশোনা আর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। সারাক্ষণ ছাত্রছাত্রীদের মঙ্গল নিয়ে ভাবে। কীভাবে প্রশ্নের মান বাড়ানো যায়, পরীক্ষার মান বাড়ানো যায় সেসব নিয়ে ভাবে। আর আমাদের ছাত্ররা? এরা গণরুমে মানবেতরভাবে থাকে, পুষ্টিকর মানসম্পন্ন খাবার পায় না, হলে নির্যাতিত হয়, ক্লাসরুমের অবস্থা ভালো নেই। সবমিলিয়ে পড়াশোনার কোনো পরিবেশই নেই। তারপরেও যে কিছু ছাত্রছাত্রী ভালো করে এটাই আমার কাছে অষ্টমাশ্চর্যের মতো লাগে।
আমাদের যদি পিএইচডি ছাত্র থাকতো তাদের টিচিং এসিস্টেন্ট বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিয়োগ দিতে পারতাম। তাদের মাধ্যমে আমরা কুইজ ও ক্লাস টেস্টের খাতা দেখাতে পারতাম। ফলে আমরা বেশি করে পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রদের পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারতাম। এখন যদি সপ্তাহে একটি ক্লাস টেস্ট নেই তাহলে সপ্তাহে প্রায় ১০০টি খাতা দেখতে হবে। এছাড়া প্রশ্ন করার জন্যতো সময় ব্যয় করতেই হবে। শিক্ষকরা যদি প্রশ্ন করা ও খাতা দেখায় সময় দিতে থাকে তাহলে আর কিছু করা সম্ভব না। এমনি এমনিই কি আর উন্নত বিশে^র বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিং এসিস্টেন্টের পেছনে টাকা খরচ করে? আসলে এরা টাকা বাঁচায়। শিক্ষকদের সময় বাঁচিয়ে শিক্ষকদের আরও ভালো কাজে লাগায় যা আরও বেশি ফল দেবে।
এই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক নেই, পিএইচডি ছাত্রও নেই। তাহলে কি তা বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে? পোস্ট-ডক ফেলো আর পিএইচডি ছাত্রই হলো গবেষণার ইঞ্জিন। তাহলে এই দুই কম্পোনেন্ট ব্যতীত পড়াশোনার মানও ভালো হবে না আর গবেষণাও ভালো হবে না।
আপনার মতামত লিখুন :