শিরোনাম
◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক ◈ বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বাস ঢু‌কে প্রকৌশলী নিহত ◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন

প্রকাশিত : ২৪ নভেম্বর, ২০২০, ০৮:০৮ সকাল
আপডেট : ২৪ নভেম্বর, ২০২০, ০৮:০৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কোভিড ভ্যাকসিনত্রয় পর্যালোচনা

ডঃ শোয়েব সাঈদ, কানাডা থেকে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউের চাইতে সংক্রমণের তীব্রতায় সন্ত্রস্ত করে তুলছে বিশ্বকে, উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপ, জাপান সর্বত্র চাপে আছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। অবস্থার উন্নতি না হলে অনেক দেশেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। সংক্রমণের তীব্রতা ভয়ানক হলেও মৃত্যুর হার খুব কম, তবে পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে মৃত্যুর হার লাফিয়ে বাড়তে পারে বলে উদ্বিগ্ন কর্তৃপক্ষ। এই রকম কঠিন অবস্থায় অন্য ফ্রন্টে প্রত্যাশিতভাবে একের পর এক ভ্যাকসিনের সুখবর হতাশার মাঝেও আশার আলো ছড়াচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠতা বা সত্য মিথ্যার নানা গুঞ্জনে সবার প্রত্যাশা হচ্ছে সঠিকভাবে ভ্যাকসিনের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া। গতকাল একটি কলাম লিখেছিলাম কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে। আজকের কলামটি কয়েক সপ্তাহ যাবৎ আশার আলো ছড়ানো তিনটি ভ্যাকসিনের বৈজ্ঞানিক তথ্যউপাত্ত নির্ভর বাস্তব অবস্থা নিয়ে।

বেশ কিছুদিন যাবৎ হিউমেন ট্রায়ালের ফেজ তিন এ কাজ করছে যে কয়েকটি ভ্যাকসিন প্রার্থী তাদের অন্যতম হচ্ছে ফাইজার, মর্ডানা আর এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনত্রয়। এই ভ্যাকসিন তিনটি আপাতত দৌড়ে এগিয়ে থেকে এক্ষণে রেগুলেটরি অনুমোদনের দ্বারপ্রান্তে। আগামী মাস নাগাদ তাদের অনুমোদনের বিষয়টি সুরাহা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ফাইজার, মর্ডানার ভ্যাকসিনের ৯৫% কার্যকারিতায় পর সাম্প্রতিকতম সুখবর এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের দুইটি মোড অব একশনের একটিতে ৯০% কার্যকারিতা। ওয়াশিংটন পোস্ট ২৩শে নভেম্বরের প্রবন্ধে জানাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ প্রশাসনের (এফডিএ) বিশেষজ্ঞ/উপদেষ্টা প্যানেল কার্যকারিতা আর নিরাপত্তার বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে ডিসেম্বর নাগাদ অনুমোদন পাবে একটি বা দুটি বা এই সব কয়টি ভ্যাকসিন। এফডিএ অনুমোদনের এক বা দুইদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি উচ্চ ঝুঁকি প্রবণ জনসংখ্যার ভ্যাকসিন পাবার অগ্রাধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সরকারি প্রোজেক্টের ৪০ মিলিয়ন ডোজের উৎপাদনে যাবে ফাইজার আর মর্ডানা। এসট্রাজেনেকা ৪ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করবে ডিসেম্বর নাগাদ এবং ২০২১ সালের প্রথম তিনমাসে সরবরাহ করবে ৪০ মিলিয়ন ডোজ। ভ্যাকসিন উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর তৎপরতা আর এফডিএ এর অনুমোদন প্রক্রিয়া আপদকালীন জরুরী প্রয়োজনে নজিরবিহীন দ্রুততার সাথে ঘটতে যাচ্ছে। তবে সব কিছু ঠিকঠাক থাকার পরও উন্নত দেশের সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে ভ্যাকসিন আসতে এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ জনগণের অপেক্ষার পালা হবে আরেকটু দীর্ঘ। সাপ্লাই চেইন অর্থাৎ সংরক্ষণ আর বিতরণে তাপমাত্রা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিচ্ছে।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক ফাইজার যুক্তরাষ্ট্রের তথা বিশ্বের অন্যতম বড় বহুজাতিক ফার্মা কর্পোরেট। বায়োএনটেক হচ্ছে জার্মান কোম্পানি, যারা ম্যাসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি ভিত্তিক ক্যান্সার থেরাপি, ড্রাগ আর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে নিয়োজিত। ফাইজার আর বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিন BNT162b2 এর ৯৫% কার্যকারিতা পশ্চিমা বিশ্বে আশার আলো ছড়িয়েছে বিগত সপ্তাহগুলোতে। বায়োএনটেকের টার্কিশ-জার্মান দম্পতি প্রফেসর শাহিন, ডঃ টুরেসি এই মুহূর্তে বৈশ্বিক সেলিব্রেটি। ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিনগুলোর বড় জটিলতা হচ্ছে তাপমাত্রার প্রতি অতি স্পর্শকাতরতা, উদ্ভাবন প্রক্রিয়া থেকে উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ এমনকি রোগীকে ভ্যাকসিন দেওয়া পর্যন্ত এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর অবকাঠামোজনিত সীমাবদ্ধতায়। এই ভ্যাকসিনের সাপ্লাই চেইনের জন্যে দরকার মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রার অবকাঠামো। এমনিতেই বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহে দরকার হাজার হাজার ফ্লাইট পরিচালনা, তার উপর আলট্রা কোলিং সিস্টেম বাড়তি উপদ্রব হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে ফাইজার ড্রাই আইস ভিত্তিক জিপিএস ট্র্যাকিং নির্ভর কোলার বক্স ব্যবহার করতে চাচ্ছে। হিমায়িত ভ্যাকসিনের ৫টি ডোজ প্যাকেট করা হবে ২ মিলিমিটারের গ্লাস ভায়ালে, একটি ট্রেতে থাকবে ১৯৫টি ভায়াল, ৫টি ট্রে থাকবে একটি বক্সে যা আবৃত থাকবে ২৩ কেজি ড্রাই আইস দিয়ে। ফ্রোজেন ভ্যাকসিন গলিয়ে তরল করার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহৃত না হলে ফেলে দিতে হবে। জিপিএস ট্র্যাকিং এ তাপমাত্রা মনিটর করা যাবে। এই সমস্ত জটিলতায় ফাইজারের ভ্যাকসিনের দাম হবে অনেক বেশী। অন্য কোন বিকল্প না থাকলে এই ভ্যাকসিন ব্যবহারে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে কানাডার মত দেশগুলো। সমস্যা হবে গরীব দেশগুলোর।

যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক কোম্পানি মডার্না ম্যাসাচ্যুসেট অঙ্গরাজ্যের ক্যামব্রিজ ভিত্তিক। ম্যাসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি নির্ভর ভ্যাকসিন আর ড্রাগ উদ্ভাবন, উন্নয়নে রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। কোভিড ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে মডার্নার সাথে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)। সরকারে পাশাপাশি আর্থিক সহায়তায় রয়েছে মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। মডার্নার ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন mRNA-1273 এর ফেজ তিনের ট্রায়ালে কার্যকারিতা অর্জিত হয়েছে ৯৫%। মডার্নার বড় সুবিধে হচ্ছে ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিনের নিম্ন তাপমাত্রায় চাহিদার লাগাম অনেকটাই টেনে ধরতে পেরেছে। মডার্না ভ্যাকসিনের সাপ্লাই চেইনের জন্যে দরকার মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রা। গৃহ কাজে ব্যবহৃত ফ্রিজের ফ্রোজেন অংশ বা ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা হচ্ছে মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড বা এর কাছাকাছি। এই তাপমাত্রার ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা সীমিত আকারে অনেক দেশেই আছে। তরল নাইট্রোজেনের বিশেষায়িত ফ্রিজের দরকার নেই। ফাইজারের মত একই ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন হলেও সাপ্লাই চেইন অবকাঠামোতে সুবিধেজনক অবস্থানে আছে মডার্না ভ্যাকসিন।

এসট্রাজেনেকা হচ্ছে ৭০ হাজার কর্মীর ব্রিটিশ-সুইডিশ বহুজাতিক ফার্মা কর্পোরেট যার সদর দপ্তর যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ ব্যবস্থাপনায় জড়িত ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে। উদ্ভাবনের দৌড়ে প্রথম দিকে এসট্রাজেনেকা অনেকটাই এগিয়ে ছিল। ফেজ ৩ ট্রায়ালে দু-বার থমকে দাড়াতে গিয়ে কিছুটা সময় নষ্ট হয়। এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন তাপমাত্রা স্পর্শকাতর নয় এবং দামও অনেক সাশ্রয়ী। রেফ্রিজেরেশন তাপমাত্রা অর্থাৎ ৪ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেডে এই ভ্যাকসিন ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে ফলে সাপ্লাই চেইন অর্থাৎ সংরক্ষণ, বিতরণে তেমন সমস্যা নেই। অক্সফোর্ড-এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন AZD1222 (ChAdOx1 nCoV-19) দুই ডোজ নির্ভর এবং প্রয়োগে রয়েছে দুইটি পন্থা। দুই পন্থায় ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল পাওয়া গেছে। একটি পূর্ণ ডোজের এক্ মাস পর আরেকটি পূর্ণ ডোজে কার্যকারিতা ছিল ৬০%। একটি অর্ধেক ডোজের এক্ মাস পর একটি পূর্ণ ডোজের কার্যকারিতা ছিল ৯০%। দুই রকম ফলাফলের কারণটি এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি এবং অপেক্ষা করতে হবে এফডিএ অনুমোদনের জন্যে এসট্রাজেনেকা কোন পন্থাটি বেছে নেয়। এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি ম্যাসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি নির্ভর নয়, ভাইরাল ভ্যাক্টর প্রযুক্তি নির্ভর। এই প্রযুক্তিতে সাধারণ সর্দিকাশির ভাইরাস এডেনো ভাইরাসের মধ্যে কোভিড ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিনটিকে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এডেনো ভাইরাসের নিজের একটি জিন মিসিং থাকায় ভ্যাকসিনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি মানুষের দেহে ভাইরাল লোড তৈরি করতে পারেনা অর্থাৎ রেপ্লিকেট করতে পারেনা। বরং জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড এই এডেনো ভাইরাস শরীরে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে শরীরকে এন্টিবডি তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে ফলে রিয়েল টাইমে ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শরীর প্রস্তুত থাকে। দাম, সংরক্ষণ, বিতরণ ব্যবস্থায় সুবিধেজনক অবস্থানে আছে এসট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। কার্যকারিতা আর সেফটি রিভিউতে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় টিকে গেলে মানব কল্যাণে সৃষ্টি করবে ইতিহাস।

লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়