ডেস্ক রিপোর্ট : মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগে কুয়েতের কারাগারে বন্দি এবং সে দেশের আদালতে বিচারের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য (লক্ষ্মীপুর-২) কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল সংসদ অধিবেশনে ২৮ কার্যদিবস অনুপস্থিত। গত ৬ জুন পাপুলকে গ্রেফতার করে কুয়েতের পুলিশ। ইতিমধ্যে সেখানে তার বিচার শুরু হয়েছে এবং তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে তার বিষয়ে এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি বা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানে না জাতীয় সংসদ।
কোনো সংসদ সদস্য গ্রেফতার, আটক বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী তা সংসদ বা স্পিকারকে জানাতে হয়। তবে পাপুলের বিষয়ে সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ স্পিকারকে এখনো কিছুই জানায়নি।
এ বিষয়ে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী রবিবার বলেন, ‘সংসদ সদস্য পাপুলের বিষয়ে সংসদকে এখনো কেউ কিছু অবহিত করেনি। যা কিছু দেখছি পত্রপত্রিকায়। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী স্পিকারকে অফিসিয়ালি অবহিত করতে হয়। তাছাড়া যেহেতু দেশের বাইরের আদালতের বিষয়, সেক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু ভিন্ন। সংসদ বা স্পিকারকে কেউ অবহিত না করলে তো আমরা নিজ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারি না। তাই এই মুহূর্তে তার বিষয়ে আমার বা সংসদের কিছুই করার নেই।’
পাপুলের বিষয়ে সংসদ কিংবা স্পিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করার দায়িত্ব কার? এই প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, ‘যেহেতু এটা বিচারাধীন বিষয়, তাই সেক্ষেত্রে কুয়েতের সরকার বা সে দেশের আদালত যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু জানিয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রণালয় সংসদকে অবহিত করতে পারে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু জানানো হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে আমার জানা নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সংসদকে কিছু জানায়নি। অধিবেশন চলাকালীন যদি অবহিত হই তাহলে সেটি সংসদকে আমি জানাব, আর যদি অধিবেশন না থাকাবস্থায় অবহিত হই তাহলে সংসদ সদস্যদেরকে চিঠির মাধ্যমে জানাব, এটাই তো নিয়ম।’
তবে এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, কুয়েতে বাংলাদেশের যে দূতাবাস রয়েছে তারাও বিষয়টি সংসদকে অবহিত করতে পারে। এমপি পাপুলের যে সেখানে বিচার হচ্ছে সে বিষয়টি দূতাবাস তাদের প্যাডে সংসদ বা স্পিকারকে অবহিত করতে পারে।
সংবিধানের ৬৭(খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পিকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সংসদ সদস্য টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে। যেহেতু পাপুল এখন পর্যন্ত ২৮ কার্যদিবস অনুপস্থিত রয়েছেন, সেই কারণে ঐ ৯০ কার্যদিবসের বিষয়টি পাপুলের ক্ষেত্রে এখনো বিবেচনায় আসছে না। এ বিষয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, ‘৯০ কার্যদিবস তো এখনো হয়নি। তাই তাকে এখনো অনুপস্থিত বলার সময়ও আসেনি।’
পাপুলের এমপি পদের ভবিষ্যত্ কী
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে ‘সংসদে নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা’ সম্পর্কে বলা আছে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে—‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না, যদি-(ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে। (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি না পেয়ে থাকেন। (গ) তিনি যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন। (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘কুয়েতের আদালতেও যদি পাপুল অন্যূন দুই বছরের দণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। কোনো সংসদ সদস্য যে কোনো দেশের আদালতে দণ্ডিত হলেই তার এমপি পদ থাকার সুযোগ নেই। কারণ দণ্ডিত ব্যক্তি তো আর বাংলাদেশের আদালতে এসে আপিল করতে পারবেন না।’
পাপুল কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হলে সেটি বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শাহদীন মালিকও শফিক আহমেদের সঙ্গে অভিন্ন মত দিয়ে বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, দুই বছর বা এর বেশি কারাদণ্ড হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না। সেখানে তো কোনো সুনির্দিষ্ট দেশের আদালতের কথা বলা নেই। আমাদের সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদের মূল উদ্দেশ্যই হলো, কোনো দণ্ডিত বা অপরাধী ব্যক্তি যেন সংসদে থাকতে না পারেন। আর পাপুল সাহেব যদি কুয়েতের আদালতে দুই বছর বা এর বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে তো উনি দেশে ফিরে সংসদকে কিংবা আদালতকে বলতে পারবেন না যে, তিনি দণ্ডিত হননি।’ অবশ্য আইনজ্ঞদের কারো কারো মতে, পাপুলের এমপি পদ নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, কুয়েতে পাপুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রমাণিত হলে সে দেশের আইনে তার ৫ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন পাপুল। ঐ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে জাপার প্রার্থী নাটকীয়ভাবে ভোট থেকে সরে গিয়ে পাপুলকে এমপি হওয়ার সুযোগ করে দেন। অভিযোগ উঠেছে, এক্ষেত্রে বিপুল অর্থ লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে স্ত্রী সেলিনাকেও এমপি করে আনেন।
অনুসন্ধানে পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের ব্যাংক হিসাবে ১৪৮ কোটি টাকার ‘অবৈধ লেনদেন ও পাচারের তথ্য’ পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ১১ নভেম্বর পাপুল, সেলিনা, তাদের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম এবং জেসমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পাপুলের স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি পাপুল দেশে ফিরলে আর যেন বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠিও দিয়েছে দুদক। ইত্তেফাক