ডা. জাকারিয়া চৌধুরী: (প্রথম পর্বের পর) ঢাকা ১৬ (পল্লবী ) এবং ঢাকা ১৩ ( আদাবর- মোহাম্মদপুর ) দুই আসন মিলে ২০০৮ ইলেকশনে বিহারী ভোটার ছিল ৭৫ হাজার।গড়ে সাড়ে ৩২ হাজার। সেটা নিয়েই কত হিসেব নিকেশের বন্যা বয়ে গেল। চলুন অন্যদিকে একটু চোখ ফিরাই।
রাজা বল্লাল সেনে’র আমলে গড়ে উঠে এক প্রাচীন বসতি’র নাম গোপালগঞ্জ। ২০১১ সালের তথ্য অনুযায়ী এই জেলার জনসংখ্যা ১১ লাখ। নারী পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান। ধর্মানুযায়ী এখানে মুসলিম ৬৩.৬২%, হিন্দু ৩৫.৪১%,এবং খ্রীষ্টান ১.২ শতাংশ। সংসদীয় আ সন মোটে তিনটি। এই আসন গুলো পরম্পরা অনুযায়ী সাধারনত আওয়ামীলীগের টিকেট পাওয়া লোকেরা-ই পেয়ে থাকে। আওয়ামী আমলে সংখ্যালঘু বলে সারাদেশে যারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তাদের সম্মিলিত গড় সেখানে ৩৬.৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের মিডনাইট ইলেকশনে এই তিন আসনে মোট বৈধ ভোটার ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার ৬৬৬ জন। সে হিসেবে সংখ্যালঘু ভোটার মোট দুই লাখ ৯৮ হাজার ২৬৪ জন। প্রতি আসনে গড়ে প্রায় এক লক্ষ যার শতভাগ কাস্টিং হয় লীগের পক্ষে। এর পরে আছে মুসলিম ভোট। অনুপাত ঠিক রেখে আগের হিসেব ধরলে গড়ে মাত্র ১৫% মুসলিম ভোটের প্রয়োজন হয় সেই সব আসন গুলোতে জিতে আসতে। ফলে কোন কনটেস্ট ছাড়া শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক জোরে-ই আওয়ামীগ সেসব আসনে অগ্রিম জিতে থাকে। এই তিনটে সহ দেশে মোট পাচটি আসন আছে যেগুলো-তে লীগ কখনো হারে না।
লীগের অন্দরমহলে এই পাচ আসনকে ‘ভিক্ষার আসন’ বলা হয়ে থাকে। এদেশে নামকরা কিছু আওয়ামীলীগার ছিল এক সময় যাদের নিজভুমে ঠাই হতো না। সেজন্য তারা চেয়ে থাকতো শেখ হাসিনার দিকে। এইসব আসনে উপনির্বাচন করে যেন নিজের এম্পি পদটা বাগিয়ে নেয়া যায়। মাইনরিটি ভোটের ক্ষেত্রে সারাদেশের চিত্র এক-ই,এবং এই আপনারা-ই বঞ্চিত/লাঞ্চিত/দলিত বলতে বলতে একেবারে আমেরিকার ট্রাম্পের দুয়ারে গিয়ে কোলাকুলি করেন কিন্তু ভোটের বেলায় কখনো ব্যাক্তি চিন্তা নির্ভর ভোট প্রদান করেন না। ভোট দেন ধর্মীয় বিশ্বাস যে প্রতীকের উপর আছে সে মার্কায়। আপনার মার্কা তো সারাজীবন ক্ষমতায় থাকেন না, আপনারা তবে অবিরাম চিৎকার করেন কেন,কিসের ভিত্তিতে ? আপনারা কখনো কেন এদেশে গনতান্ত্রিক হতে পারলেন না? ভেবে দেখেছেন কখনো ? আয়নায় নিজেদের দেখুন।
ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠায় আপনাদের ভুমিকা কোনো অংশে কম সে দাবি করার সাহস কি রাখেন নাকি রাখেন না ? বিষয়টা স্পষ্ট করা দায় আপনাদেরই। মজার ব্যাপার কি জানেন ? আওয়ামী মুসলিম লীগের বাই প্রোডাক্ট হলো বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে যারা ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের সাথে বারবার আঁতাত করেছে। জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ,কওমি, হেফাজত থেকে শুরু করে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল পর্যন্ত এমন কেউ নেই যাদের সাথে লীগের গোপন সম্পর্ক থাকে না বা ছিল না। লীগে গেলে আজ যারা হয়ে যান লীগপাতা, লীগের বাইরে গেলে সে-ই তারা-ই হয়ে তেজপাতা। আওয়ামীলীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজতক ২০২১ পর্যন্ত দলটি যতবার ক্ষমতায় এসেছে কিংবা ক্ষমতাচর্চা করেছে তা কোনোবারে-ই স্বাভাবিক গনতন্ত্রের হাত ধরে করেনি। সামরিক ক্যু থেকে শুরু করে নাশকতার আগুন-ই ছিল দলটির ক্ষমতায় আসার মুল চাবিকাঠি। যে নাশকতার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে বাস, ট্রেন, প্রাইভেট গাড়ি থেকে শুরু করে দেশ ও দশের সম্পদ, সাথে পুড়ে ছাই হয়েছে নিরপরাধ গার্মেন্ট ফেরত শ্রমিক থেকে শুরু করে বাসে ঘুমন্ত যাত্রীর দল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের চরম সাম্প্রদায়িক এই ওয়ান আইড আচরন নিয়ে কেউ কখনো কোনো প্রশ্ন তুলেনা। কেন তুলেনা জানেন ? পাছে সাম্প্রদায়িকতার ট্যাগ খেতে হয়। অথচ এদেশের বিশাল জনমানুষের দল অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষায় শিক্ষিত,অভ্যস্ত এবং পরমত সহিষ্ণু।
DW এর সাংবাদিক শ্রী সমীর কুমার দে যে চোখ দিয়ে দেখে ৭৫ হাজার ভোটকে-ই বিশেষভাবে বোল্ড অক্ষরে লাইনিং করেছিলেন,সে চোখে যদি ৩০০ আসনের দিকে তাকাই তবে চিত্র তো একই দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এমন কোন আসন আছে যেখানে বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার নেই। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা কেন এবং কিভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, মি সমীর কুমার দে’র করা রিপোর্টা যেন তার-ই এক জীবন্ত দলিল। চলুন পাঠক ফিরে যাই পুরনো কথায়। পল্লবী’র বিহারী ক্যাম্পের এসপিজিআরসি’র সাধারন সম্পাদক সাব্বির আলম বলেন-বিহারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা সবাই আওয়ামীলীগ বিরোধী ( একটা প্রশ্ন কি মাথায় আসছে না,যারা জীবনেও স্বাধীন বাংলাদেশে ভোট দিতে পারল না, ভোটের আগেই অভিযোগের আংগুল কেন উঠল তাদের বিরুদ্ধে ? কারা তুলল ? কেন তুলল ? এটাকে কি আপনি কোন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পার্ট বলবেন নাকি ভোটের আগেই তাদের ভোটের বিষয়টা নিশ্চিত করার অগ্রিম এগ্রিমেন্ট বলবেন ? ) সাব্বির আলম নিশ্চিত করেন এই বলে যে, বিহারীরা লীগ বিরোধী কথাটা একেবারে-ই ভুল। ইলেকশনে তারা এর প্রমান রাখবেন। এটা-ই চরমপন্থা। মাইনরিটি নিয়ে ব্লেম গেমের একটা অসাধারন উদাহরন। আবার তাদের পেছনে আছে আরেক বৃহৎ শক্তি।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাবরি মসজিদ কান্ডে বিজেপি’র ক্ষমতায় আসার কথা। অন্যদিকে মুসলিম কলোনীগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে-ই দিল্লির দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন গুজরাটের কসাই খ্যাত মি মোদী। তারপর গোধরা রেলস্টেশনের এক চা ওয়ালাকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই হাজার মুসলিমকে হত্যায় বাংলাদেশের বিএনপি সরকার নিরব ছিল। ফলে মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার পর সরকারী খাত তো দূর কি বাত; বেসরকারী খাতেও মুসলিমদের চাকুরি দিতে অস্বীকৃতি,বাসা ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি ভারতকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের মধ্যমনি করে তুলেছে। আর এতে অনুপ্রানিত হয়েছে এদেশের একটা শক্তি এবং মিয়ানমার। আগুন যখন লাগে সে কি দেবালয় দেখে ? দেখেনা। আমরা ভারতের কাছ থেকে দেশপ্রেম শিখতে পারতাম, তাদের মানের পড়াশোনা শিখতে পারতাম। অথচ কি শিখলাম ? শিখলাম আগুনের জয়যাত্রা। সর্বনাশের আগুনে পুড়ছে আজ গোটা বাংলাদেশ। উভয় দেশে-ই এসবের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যারা নিজেদের সেক্যুলার বলতে খুব আরাম পান। আরে ভাই সেক্যুলার তো আমিও। সেটা প্রমান করতে নিজ গায়ে আগে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে নাকি !!
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ইলেকশনে কালসির ভোট কাদের পক্ষে বা বিপক্ষে পড়েছিল সে তথ্য আমার কাছে নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু ২০১১ সালে পরিকল্পিত সেই লুটপাট ও গনহত্যার শিকার হয়েছিল ওই বিহারীরাই। এদেশে তারা ভোটার হয়েছে ক্ষোভের আগুন ছিল সেখানে। যারা একদিন নিজ মাতৃভূমি ভারত থেকে-ই এসেছিল। শিকার আর সেলাইয়ের ভয় আমার আছে। আমি পরাজয় স্বীকার করে চলা মানুষ। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই সেখানে বিজয়ী হবার আছেটা কি !!যেখানে গনতন্ত্র নেই সেখানে আমি এইসব কথা বলেছি কি বলিনি তা কোনো মানে বহন করে না। (সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি: ডেন্টাল সার্জন, কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :