ডেস্ক রিপোর্ট: সৈয়দ মহিউদ্দীন হাশেমী, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা শহরের অদূরে বিনেরপোতার বেতনা নদীর তীরে ১৯৮৬ সালে ১৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরী। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, বহুমুখী যাতায়াত ব্যবস্থা ও বর্জ্য নিষ্কাশনের কথা চিন্তা করে প্রমত্তা বেতনা নদীর তীরকে বেছে নেওয়া হয় তখন। এরপর ৩৪ বছর পার হলেও লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া, গড়ে ওঠেনি নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান। শেয়ার বিজ নিউজ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকসই পরিকল্পনার অভাব, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে জরাজীর্ণ এই শিল্পনগরী। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়সারা কার্যক্রম এবং উদাসীনতার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীরও নেই। এছাড়া অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনা ও সারা বছর জলাবদ্ধতার মতো নানামুখী সংকটে জর্জরিত সাতক্ষীরার এই শিল্পনগরী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনার ফলে পানি নিষ্কাশনের অভাবে রাস্তার ওপরেই জমে আছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ও পানি। নেই কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থান। নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীর না থাকায় যত্র-তত্র ঘোরাফেরা করছে গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন জীবজন্তু। পানি নিষ্কাশনের অভাবে রাস্তার ওপরেই পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দের। চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো। ৩৪ বছর আগে নির্মিত পানির প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বেশিরভাগ সময় থাকে নষ্ট।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, মোট ৯৬টি প্লটের পাঁচটি বাদে সবকটিই বরাদ্দ শেষ হয়েছে। এর ভেতরে তিনটি আইনি জটিলতা ও দুটি বিসিকের প্রধান কার্যালয় থেকে সংরক্ষিত রয়েছে। ৩০টি শিল্প ইউনিটের বিপরীতে ৯১টি প্লট বরাদ্দ হলেও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় ফাঁকা পড়ে আছে অনেক প্লট, আবার বেশ কয়েকটি কারখানা কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করলেও উৎপাদনের কার্যক্রম এখনও শুরু করতে পারেনি।
জানা গেছে, বর্তমানে বিসিকে চলমান রয়েছে চিংড়ি পোনা হ্যাচারি ও প্রক্রিয়াজাত কারখানা, বেকারি ফুডস, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ সেন্টার ও লবণশিল্পের কারখানায়। এসব প্রতিষ্ঠানের অব্যবহƒত বর্জ্য পানি বদ্ধ ড্রেনের কারণে রাস্তায় জমে থাকছে। বিসিক অঞ্চলে নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীর না থাকায় বিভিন্ন সময়ে চুরির ঘটনাও ঘটেছে। কিছু প্লটে কারখানার নাম-ঠিকানাসংবলিত প্লাকার্ড পুঁতে রাখলেও নেই কোনো কার্যক্রম।
শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর বিরূপ মনোভাবের কারণে বিসিকের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি বিসিকের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে একটি দ্বিতল ভগ্ন ভবনে। মাঝে মাঝে পলেস্তারা খসিয়ে নতুন করে পলস্তারা করে ভবনটিতে চলছে কার্যক্রম।
বিসিকে উৎপাদনরত চিংড়ি বাংলা হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী শেখ বশির আহমেদ মামুনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বিসিকের সরবরাহকৃত পানি ব্যবহার অনুপযোগী। আমাদের নিজস্ব পাম্পের ব্যবস্থা আছে। বিসিকের পানির প্লান্টটি বছরের অধিকাংশ সময়ই নষ্ট থাকে। হ্যাচারির সামনের রাস্তাটিও বেহাল। যাতায়াতের ব্যবস্থা খুবই নাজুক। উৎপাদন মৌসুমে নিজ উদ্যোগে রাস্তা মেরামত করতে হয়। হ্যাচারির পানি বের হওয়ার মতো ড্রেনের ব্যবস্থাও নেই এখানে। উল্টো বেতনা নদীর পানিতে জলমগ্ন থাকে এলাকা।’ অব্যবস্থাপনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
পান্ডে ফাইবার ইন্ডাস্ট্রির মালিক সুরেশ পান্ডে বলেন, ‘কারখানার সামনের রাস্তা নিজ উদ্যোগে বহুবার সংস্কার করেছি। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন।’ পানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বহু আগে নির্মিত পাম্প। এ কারণে পানি আয়রনযুক্ত, যা খাওয়ার অনুপোযোগী।’
বিসিকের একটি ফুডস ইন্ডাস্ট্রির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে যে বিসিক শিল্প নগরী, তা বোঝা যায় না। দিনে গরু-ছাগলের চারণভূমি আর রাতে বখাটেদের আনাগোনা ও মাদক সেবনসহ চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। সীমানা প্রাচীর না থাকার কারণেই এরকম অবস্থা। এগুলো দেখাশোনা করার কেউ নেই।’
এ বিষয়ে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সমিতি সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘বিসিকের অসহযোগী মনোভাবের কারণে উন্নয়নের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো পরামর্শ দিলে তারা তা মেনে না নিয়ে বরং
এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নিলেও সুযোগ-সুবিধার কোনো বালাই নেই বিসিকে। সর্বত্র শুধু সমস্যা আর সমস্যা। ব্যবসায়ের কোনো পরিবেশ নেই এখানে।’
জানতে চাইলে সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক গৌরব দাশ বলেন, ‘পানি, রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতাসহ নানামুখী সংকটে রয়েছে সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরী। সংকটগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে সাতক্ষীরাসহ আটটি শিল্প নগরীর উন্নয়ন নিয়ে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ সাপেক্ষে কাজ শুরু হলে দ্রুত সংকট নিরসন হবে।’ পাশাপাশি বিসিকের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :