শিরোনাম
◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী

প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ০৪:৪৭ সকাল
আপডেট : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ০৪:৪৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: ১২ নভেম্বর, বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তি দিবস

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : ১২ নভেম্বর। বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তির দিবস। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর সেই সাথে সুগম হয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত বঙ্গবন্ধুহত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যাসহ অসংখ্য বিচারবহির্ভূত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাসমর্থিত খোন্দকার মোশতাক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন সময়ে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।

ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

একটি সভ্য দেশে এমন আইন প্রণয়ন করা কি সম্ভব? আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বিশে^র প্রতিটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সমাজে অপরাধ হলে, বিচার হতেই হবে। আর তা না হলে সেই সমাজ অপরাধের চোরাগলিতে ডুবে যায়। কিন্তু এই যে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ এটা কোন সভ্য দেশের আইন হতে পারে না। অপরাধীকে অপরাধের দায়ভার থেকে মুক্তি দেয়া মানেই হলো সমাজে আরও অপরাধ সংঘটনকে উৎসাহিত করা যেটা কখনই কাম্য নয়। আর আমরা ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঠিক এই কাজটি-ই করেছি। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর তার বিচার তো দূরের কথা, বরং আইন করে তার তদন্ত ও বিচার চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাবস্থা করেছি। এই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের বহু বছর লেগেছে। এমন কলঙ্কিত অধ্যায়ের দৃষ্টান্ত বিশ্বে সত্যিই বিরল।

এরপর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়। পঞ্চম সংশোধনীটি নিজে কোনো আইনের সংশোধনী নয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনি বৈধতা দান করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মূলকথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখসহ ওই দিন থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত (ওই দিনসহ) সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের যে কোনো ঘোষণা বা আদেশ বলে সম্পাদিত সংবিধানের সকল সংশোধনী, সংযুক্তি, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলুপ্তি বৈধভাবে সম্পাদিত বলে বিবেচিত হবে এবং কোনো কারণেই কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এসবের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এরূপে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকা-পোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

কেন পাকা-পোক্তভাবে দায়মুক্তির কথাটি বললাম তার যথেষ্ট কারণ আছে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অতএব, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিলনা। কিন্তু ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ আগস্ট খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থাটিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ পরিণত করা হলো। একই সাথে এটাও বোঝানো হলো যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। আর এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতো।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬- এক সুদীর্ঘ ২১ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। অতঃপর, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তার রিপোর্টে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন ৫ম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো, যা পরবর্তীকালে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং কমিটির মতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা সম্ভব।

কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীরের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর আজ সেই কলঙ্কমুক্তির দিন। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পদযাত্রার দিন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দিন।

লেখক : আইনজীবী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়