দীপক চৌধুরী: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ এবং সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। দেশের ইতিহাসে তাঁর অবদান সংক্ষেপে বলা কঠিন ও এক ধরনের অস্বস্তি। অকুতোভয় এই কূটনীতিবিদ ইতিহাসের কিংবদন্তি। বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতায় তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও মুগ্ধ হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের রোষানলে পড়ে নির্যাতিত হলেও অপ্রতিরোধ্যগতিতে নিজ মেধায় এগিয়ে গেছেন ঈপ্সিত লক্ষ্যে। তিনি কূটনীতিক, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বাংলাদেশের স্পিকার নির্বাচিত হন। বলা যায়, আমাদের জাতীয় সংসদকে গতিশীল, আধুনিক ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শও গ্রহণ করেছেন। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মহান জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি জাতির পিতার খুনীদের বিচারের আওতায় আনতে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, জাতীয় সংসদকে শক্তিশালীকরণ এবং সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রচলনসহ যুগান্তকারী নানারকম কার্যক্রম গ্রহণ করেন। অত্যন্ত উদার মনের এই কৃতি সন্তানের জন্মদিন আজ। তাঁর পিতা মরহুম আব্দুর রশীদ চৌধুরী ও মাতা মরহুমা বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী। সিলেটের আম্বরখানার রশীদ মঞ্জিলের প্রাণপুরুষ মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি বা স্থায়ী ঠিকানা দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দরগাপাশা।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর তিনি সিলেটে ( তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত, বর্তমান বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। ২০০১-এর ১০ জুলাই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যান। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব¡পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনে প্রথম বাঙালি হিসেবে সভাপতিত্ব করার বিরল গৌরব অর্জন করেন।
‘স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পরিষদে’র সভাপতি সাবেক প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি মো. নজিবুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা। পরিষদ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী এক মহাপ্রাণ’ শীর্ষক অসাধারণ একটি সংকলন করে করেছিল। এতে ‘‘আধুনিক জাতীয় সংসদের রূপকার স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী’’ শিরোনামে মো. নজিবুর রহমান একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেন। পরিষদের সভাপতির আমন্ত্রণে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার শিল্প একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। দেশপ্রেমিক, সজ্জন ব্যক্তি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বহুমাত্রিকতা নিয়ে আলোচকদের চমৎকার বক্তব্যে সেদিন আরেক দফা বিমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আন্তর্জাতিকতার অসাধারণ উচ্চতার নানাকথা গুণী বক্তাদের আলোচনায় ওঠে আসে।
১৯৭৫-এর পনের আগস্টের পর তার যে অনন্য অবদান, এমনি সাহসিকতার স্বাক্ষর তিনি তার কীর্তিময় জীবনে রেখেছেন। হুমায়ুন রশীদ তৎকালীন পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেইসব হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তার অন্যতম- যিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের লোভনীয় চাকরির প্রলোভনকে পাশে ঠেলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নয়াদিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশের দুঃসাহস দেখান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। হুমায়ুন জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকচক্রের নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের নৃশংস-নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে তিনি পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর বাসভবনে নিরাপদে রাখেন এবং তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নেন।
আধুনিক সিলেটের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে তিনি সিলেটবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহকর্মী হিসেবে ডেপুটি স্পিকার ছিলেন আমাদেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
লেখক : উপ-সম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :