শিরোনাম
◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে

প্রকাশিত : ০৭ নভেম্বর, ২০২০, ০৮:৩৮ সকাল
আপডেট : ০৭ নভেম্বর, ২০২০, ০৮:৩৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ডাঃ সৈয়দা মেহবুবা জ্যোতি: পথশিশু

প্রায়ই বাসায় ফেরার সময় বাসার বেশ খানিকটা দূরে জ্যামে বসে থাকতে হয়। সে সময় দেখি বিভিন্ন বয়সের পথশিশুরা ডাস্টবিনে রাস্তায় ময়লার ভিতর দিয়ে কিছু টোকাচ্ছে, কেউ বা ফুল বিক্রি করছে। একদিন আমার চোখে পড়ল আমার বাসার পাশে গাছের নীচে একটা ১০-১২ বছরের মেয়ে মাটিতে একটি মহিলার ছবি আকঁছে। অতঃপর ওই ছবির ওপর ঘুমিয়ে পড়ছে। বেশ কয়েকদিন খেয়াল করলাম মেয়েটিকে। শেষ রাতে দিকে মেয়েটা চলে যায়। ও একজন পথশিশু। আমার অনেক কৌতুহল হল, একদিন কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরেই ওকে ডাকলাম। শুনলাম তার জীবনের কথা। জিজ্ঞেস করেছিলাম- নাম কি তোমার? কোথা থেকে এসেছো? তোমার কি বাবা-মা নেই? কীভাবে এসেছো এখানে? অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক করছিল মনের ভিতরে। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বলেছিল- কেনগো আপা? নাম শুইন্না হাসবেন নাতো? বাবা-মা ছিলো। গ্রামেই জন্ম আমার । গ্রামের নাম ভোলা আমার বাপটা ভাতের অভাবে মারা গেছে। বাপ-মা আর আমি এই নিয়ে ছিল আমাগোর পরিবার। বাপ মারা যাওয়ার পর মা-এ আবার বিয়া বইছে। হেইদিনই গ্রাম হইতে আইয়্যা পড়ছি। গ্রামের লোকে মা তুইল্লা গাইল দেয়, নাম ধইরা হাসে। কয়-গরীবের ঘরের ঝি। পারে না দুইবেলা খাইতে নাম রাখছে আলো। ঢং কতো!

ও আবারও বলতে লাগল- জাহাজে উঠ্যা হেইদিনই চইল্যা আইছি এই শহরে। অনেক টাকা জমাবো, এখন খাইতে পারি না হ্যাতে কি? একদিন অনেক টাকা জমাব। এরপর নতুন একটা মা কিনবো। যাতে মা আর খাওয়ার অভাবে বিয়া না বইতে পারে। আমারে ছাইড়া চইল্যা না যাইতে পারে।

আমি খুব হতবাক হয়ে শুনছিলাম। আবার বললাম, তোমার নামটা অনেক সুন্দর আলো। টাকা দিয়ে কখনো হয়তো মাকে কেনা যায় না কিন্তু জীবনের এই নির্মম দশা হতে মুক্তি পেতে টাকার কোন বিকল্প নেই তা স্বীকার করতেই হবে। আচ্ছা সারাদিন তুমি কি কি করো?

আলো আনমনে একবুক কষ্ট নিয়ে বলতে লাগল-সকালে উঠে রাস্তা দিয়া এটা-ওটা টুকাই। ডাস্টবিনে মাঝে মাঝে ময়লার মধ্য দিয়ে খাবার উঠায়া খাই। কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে লাগল- অনেক সময় ক্ষুধার জ্বালায় দোকানের সামনে গিয়া খাইতে চাই। দেয় না ওরা। তবে মাঝে মাঝে দুই-পাঁচ টাকা দেয়। যে মানুষ না খাইতে পাইরা খাবার ফালাইয়া দেয়, হেইয়া উঠাইয়া খাই। বড়লোকগো কাছে গিয়াও খাবার চাই। কিন্তু দেয় না। বাসার পোষা কুত্তাগুলোরে দেয়, আদর কইরা খাওয়ায়। কিন্তু আমাগো দেয় না। কেউ আমাগো খাইতে দেয় না। বেশী ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট হইলে ফুক্কা টানি, গাঁজা খাই। ওই যে দূরে আমার মতো অনেকে আছে। ওগো লগে গিয়া গাঁজা টানি। গাঁজা খাইলে দুই- তিনদিন খালি ঘুমাই আর ঘুমাই। তখন আর ক্ষুধা লাগে না। নিজেরেও তখন বড়লোকের বাসার কুত্তা মনে হয়। মনে হয় আদর কইরা আমারেও কেউ খাওয়াইতেছে।

আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বললাম- তুমি ডাস্টবিনের ময়লা খাবার খাও! পেট খারাপ হয় না? তোমার পড়ালেখা করতে ইচ্ছে হয়? এভাবে রাস্তায়ই থাকো, অসুস্থ হয়ে গেলে কি করো? রাতে যে রাস্তায় ঘুমাও কোন সমস্যা হয় না? আলো আবার বলতে লাগলো- কি যে কন আপা! ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। পেট খারাপ হয় না । তবে পায়খানা হয় মাঝে মাঝে। হেইয়া হোক গিয়া, ক্ষুধার সময় যে কি খাই হেইয়া হুঁশ থাকে না। না খাইতে পারার কষ্ট যে পায় হেই বুঝে।

আর অসুখ! জ্বর-সর্দি হয়, ভালোও হইয়া যায়। গরীবের প্রাণ তো, হেইয়া হইল কই মাছের প্রাণ, সহজে যায় না। শুধু আমার বাপটাই না খাইতে পাইরা চইল্যা গেল। আর রাতে নতুন করে মানুষ চেনা যায়, রং বেরং এর মানুষ। দিনের আলোয় চেনা যায় না আপা। দিনের আলোতে যেন মনে হয় হেরা মুখোশ পরা ভদ্র মানুষ। প্রায় রাতেই দোকানদার, ড্রাইভার, বাসের হেলপার আমাগোর মতো মাইয়া-গোর লগে জোর কইর‌্যা খারাপ কাজ করে। কাপড় টানে, গায়ে হাত দেয়, জোর কইর‌্যা শারীরিক সম্পর্ক করে। তারপর দশ-বিশ টাকা হাতে দিয়া কয়েকঘন্টা পরে ছাইড়া দেয়। আবার কয় কাউরে কইলে জানে মাইরা হালাইবো।

কি আর করমু? ডাঙ্গায় থাইকাতো আর পশুর সাথে আমরা পারমু না। ওগো টাকা আছে, আমরাতো টোকাই। খাইতেই পারি না, হের পর আবার ইজ্জত! জানেন আপা- আমরাতো ভালোই, রাস্তায় যে মহিলা পাগলগুলো ঘুরে হেইগুলারে ও লইয়া যায়, খারাপ কাজ করে। দিনের বেলা কাজ চাইলে কাজ দেবো না কয়- শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। আর রাতের বেলা আকামকুকাম করতে পারবো। হেইয়া নিষিদ্ধ না! কুত্তা গুলা আবার কয় আমরা রাস্তার মাইয়া। আমরা নাকি খারাপ, নষ্ট। হেলে আপনিই কন? ওইগুলায় কি? রাস্তার কুত্তা ছাড়া আর কিছু!

আমি নিস্তব্ধ হয়ে ভাবছিলাম, শিক্ষা না, চিকিৎসা না, শুধু দুবেলা খেতে চায় ওরা। ক্ষুধার রাজ্যে অন্য কোন চাহিদাই মুখ্য নয়। তাহলে কি সমাজের প্রাচুর্যশালী ব্যক্তিরাই সকল মৌলিক চাহিদা ভোগ করার হকদার। আর দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় বসবাসকারী মানুষগুলো শুধু শোষিত ও লাঞ্ছিত হতে থাকবে? খুব অস্থিরতা কাজ করছে নিজের মধ্যে। নিজের আবেগগুলোকে আবারও একটু সামলে নিয়ে বললাম-আচ্ছা আমি দেখেছি তুমি একটা ছবি এঁকে তার উপর ঘুমাও। এটা কি? আবার বললাম-তোমাদের যে জামা-কাপড় দেয়া হয় ঈদের সময় সেগুলো ঠিকমতো পাও তোমরা?

আলো বলল, ও! ওইটা।ওটা ছবি না। আমার মা'রে আঁকি। হেরপর হের কোলে মাথা রাইখ্যা ঘুমাই। হ, জামা-কাপড় দেয় ঈদের সময়। কিন্তু খাইতেই পারি না। হেরপর আবার জামা-কাপড়! জানেন আপা, মাঝে মাঝে মন্ত্রীরা যখন সমাবেশ করে, সমাবেশে খাওয়ায়। সেই সময় রাস্তা দিয়ে টোকায় টোকায় ভাল খাবার খাইতে পারি। সবাই খাইয়া বাকী কিছুটা ময়লার মধ্যে ফেলায়। তখন হেইয়্যা খাই।

সেদিন আমি আলোকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম আমি তোমাকে কিছুদিন পর আবার ডাকবো। দেখি আমি তোমার জন্য কী করতে পারি । তার কিছুদিনের মধ্যেই একটা সংস্থা খুঁজে বের করলাম যেখানে পথ শিশুদের জন্য কাজ করা হয়। সংস্থার সদস্যরা আলোর থাকা-খাওয়া ও পড়ার ব্যবস্থা করে দিবে বলে আশ্বস্ত করলো আমায়।

সেদিন নিজের মনের কাছে নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত লাগছিল এই ভেবে যে, একজনের জন্য হলেও কিছু করতে পারবো। সেদিনই গেলাম সেখানে যেখানে আলোর সাথে আমার কথা হয়েছিল। দেখলাম, আর এক পথশিশু, ওর নাম মুক্তি। ওখানে বসে কাঁদছে। আমি বললাম- তুমি কাঁদছো কেন? এখানে যে একটা মেয়ে থাকে, আলো। ও কোথায়? ওকে তুমি চেনো? মুক্তি কিছুটা জড়সড় হয়ে বলল- হ দুদিনের জ্বরে পইড়া আজ সকালে লাশ হইয়্যা গেছে, মইরা গেছে। আবারও কাঁদছে মুক্তি। আরো বলল- ও আমার অনেক কাছের ছিল।বন্ধু ভাবতাম ওরে; আমি নির্বাক, তবুও বললাম-তুমি আর কেঁদো না। মুক্তি আবার বলতে লাগল মানুষ কুকুররে খাওয়ায়, কিন্তু আমাগো দেয় না। জ্বরের মধ্যে না খাইতে পাইয়া কষ্ট কইরা মারা গেল আলো। আমাগো কি পাপ?

সত্যিই, মুক্তির এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হচ্ছে। আজ কোন এক অজানা অপরাধবোধ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমিও কাঁদছি কিন্তু নির্বাক স্বরে। এরকম শতশত মুক্তি ও আলোদের দায়িত্ব কে নিবে?? কে?? এই প্রশ্নটি বার বার আমায় করছে মুক্তির সরল দুটি চোখ। সেদিনও ওই একই প্রশ্নই করেছিল আলো। কি আর বলতে পারি আমি!! কি আর বলার আছে আমার!! চারিদিকেই শুধু ভেলকিবাজি, সকল আশ্বাসই মরীচিকা, শুভংকরের ফাঁকি। আসুন না, আমরা সবাই এগিয়ে আসি, বাড়িয়ে দেই মানবিকতার হাত। সংস্কার শুরু হোক নিজের থেকেই।

লেখক
ডাঃ সৈয়দা মেহবুবা জ্যোতি
চিকিৎসক, গল্পকার,নৈতিক বক্তা ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়