সুজন কৈরী: দেশের বৃহৎ অনলাইন খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অভিযানে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বুধবার ফুডপান্ডার বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির মামলা দায়ের করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা।
ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর গত ১৫ অক্টোবর গুলশানে নাভানা প্রিস্টিন প্যাভিলিয়নের ফুডপান্ডা বাংলাদেশ লিমিটেডের অফিসে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল আকস্মিক পরিদর্শন করে। ভ্যাট গোয়েন্দার উপপরিচালক নাজমুন্নাহার কায়সার ও সহকারী পরিচালক মো. মহিউদ্দীনের নেতৃত্বে চালানো অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়। ফুডপান্ডার বিআইএন ০০২১৫৬০৬৬-০১০১। প্রায় ৫ হাজার ফুডস্টোর থেকে ফুড সংগ্রহ করে ভোক্তার কাছে বাইকারদের মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফুডপান্ডার চুক্তি রয়েছে, যার আওতায় ফুডপান্ডা কমিশন পায়।
পরিদর্শনকালে ভ্যাট গোয়েন্দার দলটি ভ্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে অনুরোধ করা হলে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তা প্রদর্শন করেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত কম্পিউটার তল্লাশি করা হয়। এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধতন কর্মকর্তার ল্যাপটপে মাসিক বিক্রির কিছু গোপন তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দারা ওই তথ্যসহ আরও কিছু বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করে।
ভ্যাট গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা তথ্য প্রযুক্তি সেবা অর্থাৎ সেবার কোড এস-০৯৯ দশমিক ১০ এর আওতায় নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। ওই কোডে নিবন্ধন গ্রহণ করে বাড়ি ভাড়ার উপর প্রযোজ্য মূসক পরিহার করছে। এই কোডটি কোনভাবেই তাদের ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও বাড়ি ভাড়ার উপর অবৈধভাবে শূন্য হারে ভ্যাট সুবিধা নেয়ার উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করছে।
ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্তকর্তারা বলছেন, ফুডপান্ডা মূলত ইলেক্ট্রনিক নেটওয়ার্ক (অনলাইন প্লাটফর্ম) ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করে, যার প্রকৃত সেবার কোড এস-০৯৯ দশমিক ৬০। এই কোডের আওতায় ভ্যাট ৫ শতাংশ এবং বাড়ি ভাড়ার উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য।
প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার থেকে জব্দকৃত তথ্য অনুযায়ী গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে মোট ২৭ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৭ টাকার বিক্রি তথ্য পাওয়া যায়। একই সময় প্রতিষ্ঠান স্থানীয় গুলশান ভ্যাট সার্কেলে দাখিলপত্রে ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৭২ টাকা বিক্রয়মূল্য প্রদর্শন করেছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি গত ৮ মাসে মোট ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪৫ টাকা বিক্রির তথ্য গোপন করেছে। যার উপর পরিহারকৃত মূসক ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬২০ দশমিক ৯১ টাকা প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি সেবার কোড এস-০৯৯ দশমিক ১০ এর আওতায় অসঙ্গতিপূর্ণ নিবন্ধন নেয়ায় প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা এ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়ার উপর কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি।
প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দকৃত সি.এ. রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া বাবদ ২ কোটি ৫০ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯৯ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। যার উপর প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯ লাখ ৬ হাজার ২৬ টাকা। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত জব্দকৃত ভাড়ার চুক্তি মোতাবেক বাড়ি ভাড়া বাবদ ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। যার উপর প্রযোজ্য ভ্যাট ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া বাবদ মোট ৫৬ লাখ ৬৬ হাজার ২৬ টাকা ভ্যাট পরিহার করা হয়েছে। এই বাড়ি ভাড়ার ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ বর্তায় ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৯২০ টাকা।
এছাড়া দাখিলপত্র পর্যালোচনায় ভ্যাট গোয়েন্দা দেখতে পেয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি লিমিটেড কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও পণ্য কেনার উপর কোনো উৎসে মূসক পরিশোধ করেনি। জব্দকৃত সি.এ. রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উৎসে মূসক বাবদ ১ কোটি ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৩ টাকা পরিহার করেছে। এই উৎসে ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ ৭২ লাখ ১২ হাজার ৭১৯ টাকা প্রযোজ্য।
ফুডপান্ডা বাংলাদেশ লিমিটেড পণ্য বিক্রি বাবদ ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪ টাকা, বাড়িভাড়া বাবদ ৫৬ লাখ ৬৬ হাজার ২৬ টাকা এবং উৎসে কর্তন বাবদ ১ কোটি ২৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৩ টাকাসহ মোট ২ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার ৬৫৩ টাকা ভ্যাট পরিহার করেছে। এই পরিহারকৃত ভ্যাটের উপর সুদ বাবদ ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার ২৬০ টাকা প্রযোজ্য হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে জড়িত।
ভ্যাট গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ বলছে, ভুল সেবা কোড ব্যবহার, প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন এবং উৎসে ভ্যাট না দেয়ায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বুধবার ভ্যাট গোয়েন্দা মামলা দায়ের করেছে। মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হবে।
আপনার মতামত লিখুন :