ডেস্ক রিপোর্ট: কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে এক সপ্তাহে অন্তত আট জন নিহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশাপাশি ঐ এলাকার বাংলাদেশি নাগরিকেরাও আতঙ্কে আছেন। মাদক, অস্ত্রসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসার আধিপত্যকে কেন্দ্র করেই এই সংঘাত। এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদেরও যোগাযোগ রয়েছে। এর পেছনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ইন্ধন আছে বলেও জানা গেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের প্রধান উত্সও মিয়ানমার।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন গত বুধবার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, এখানে এক সপ্তাহে আট জন নিহত হয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। ক্যাম্পে গোলাগুলি বন্ধ হলেও পরিস্থিতি থমথমে। কেন এই গোলাগুলি? জবাবে তিনি বলেন, এই ক্যাম্পে মুন্না ও সাদেক গ্রুপ নামে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দুটি বাহিনী আছে। তবে এখানে বিষয়টি হলো, মুন্না ও মুন্নাবিরোধী গ্রুপ। তাদের মধ্যেই সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের মূল কারণ ক্যাম্পের আধিপত্য। ক্যাম্পের আধিপত্য যাদের হাতে থাকে, তারাই অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ক্যাম্পে দ্বন্দ্বের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রেজিস্টার্ড ও ননরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। এছাড়া আরসার প্রভাবও আছে। আর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পক্ষে কাজ করে এমন কয়েকটি গ্রুপও আছে। তারা এখান থেকে তথ্য সরবরাহ করে। তারাও সশস্ত্র গ্রুপ। স্থানীয়রা বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মাদক ব্যবসা অর্থের একটি বড় উত্স। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ক্যাম্পে মজুত করে এখান থেকেই বণ্টন করা হয়। এছাড়া ক্যাম্প এলাকা ও আশপাশে অনেক দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায় এবং রোহিঙ্গাদের পাওয়া ত্রাণের উদ্বৃত্ত অংশ বিক্রির বড় একটি মার্কেট আছে। ক্যাম্পের ভেতরে ছয়-সাতটি বাজারও আছে। সেখান থেকেও অনেক অর্থ আদায় হয়।
মুন্না অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা আর সাদেক নিবন্ধিত রোহিঙ্গা। সাদেকের সঙ্গে আরসার যোগাযোগ আছে এমন তথ্যও জানিয়েছেন অনেকে। উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেছেন, এখন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা অনেক বেশি। নিবন্ধিতরা আগে এসেছে এবং তারা সংখ্যায় কম। ফলে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। তার মতে, ‘গত চার বছরে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, তাদের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ীও আছে। তারা ইয়াবা তৈরি করতে পারে। ক্যাম্পের ভেতরে তারা এ ধরনের কারখানা তৈরি করেছে বলে আমরা ধারণা করি। আবার কিছু রোহিঙ্গা আছে, যারা ক্যাম্পে থাকলেও নিয়মিত মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করে। তারা অস্ত্র ও ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। গত এক মাসে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ২০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
গত ২ অক্টোবর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পালংখালীতে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র্যাব। সেখান থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ সময় মজিদ ও রবি নামের দুই ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব। তাদের বাড়ি মহেষখালী এবং তারা অস্ত্র তৈরির কারিগর। র্যাব তখন জানিয়েছিল, তারা অস্ত্র তৈরি করে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে আসছিল।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবুল মোরশেদ খোকা দাবি করেন, মিয়ানমার থেকেও মাদকের সঙ্গে অস্ত্র আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, এই সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চরেরাও সক্রিয় আছে। তারা অস্ত্র দিচ্ছে। তারা চায় এখানকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে। এখানে আরসাসহ আরো কিছু গ্রুপও সক্রিয় আছে। ফলে অবৈধ সব ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হানাহানি চলছে।
ডিআইজি আনোয়ার হোসেনও স্বীকার করেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে অনেক কিছুই ঘটে, যা সব সময় জানা যায় না। এখানে যারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে, তারা তো সশস্ত্র। ফলে তাদের কাছে অস্ত্র আছে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। ক্যাম্পের মধ্যে ইয়াবার কারখানা থাকার বিষয়টিও আমরা শুনেছি। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কারণে অধিকাংশ সময় সাধারণ রোহিঙ্গারা আমাদের কাছেও সঠিক তথ্য জানাতে ভয় পান।’ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প একটি সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আর তার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই এই সংঘর্ষ। এর সঙ্গে জড়িত আছে এদেশীয় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।
শুধু কুতুপালং কাম্পেই ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। সবচেয়ে বড় ক্যাম্প হওয়ায় সেখানকার কোনো ঘটনা অন্য ক্যাম্পেও প্রভাব ফেলে। কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া—এ দুটি ক্যাম্প রেজিস্টার্ড হলেও মোট ক্যাম্প ৩৪টি।ইত্তেফাক