মো. আখতারুজ্জামান : ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এটাকে করোনাকালিন ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছে তার প্রতিফলন বলছেন।
গত মঙ্গলবার আইএমএফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে। আর আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, করোনা মহামারী শুরু থেকে বলে আসছিলাম আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখবে কৃষি। বিভিন্ন সংস্থার জিডিপির পূর্বাভাসে সেটাই বোঝা যাচ্ছে। বিশ্বে বড় বড় অর্থনীতির দেশে করোনাকালে নিম্নমুখী থাকলেও আমাদের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থানে আছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় নানা বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক বলেছে ১.৬ শতাংশ আর আইএমএফ বলছে ৩.৮ শতাংশ। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেক ব্যবধান। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি রয়েছে তাতে প্রবৃদ্ধি এর চেয়ে অনেক ভালো হবে। এডিবি যে প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে তার থেকেও আমার ভালো করবো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চেয়ে আমাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি নির্ভর করছে আগামী আট মাস রয়েছে তার মধ্যে আমরা কতো দ্রুত করোনার টিকা পাই এবং করোনাকে মেনে নিয়ে যদি আমরা ভালো ভাবে এগিয়ে যেতে তার ওপর। আমি মনে করি প্রবৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন দরকার সরকার যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তায়ন করা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, তাদের পূর্বাভাস নিয়ে আমরা কথা বলবো কেনো, তারা আমাদের পূর্বাভাস নিয়ে কথা বলবে। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক কি। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের কোনো কথা শোনা ঠিক না। তাদের কথা যারাই শুনবে তারাই বিপদে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তিন দালালের দুটি। অন্য দালালটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডাব্লউটিও)। এই তিন দালালের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে হবে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাদের মুখ থেকে কোনো কথাবার্তা আমাদের শোনার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশে জিডিপি নিয়ে সরকার যে তথ্য দিয়েছে তা মিথ্যা দিয়েছে। কারণ অর্থমন্ত্রী জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বিষয়ে যেটা বলেছেন, সেটা তিনটা কোয়ার্টারের উপর ভিত্তি করে। আর করোনাভাইরাস আসছে তারপরের কোয়ার্টারে। এটা একটা জালিয়াতি। আমি বলছি এটা হিসাবপত্রের জালিয়াতি। কোভিডের সময়কাল বাদ তার পেছনের ৯ মাস ধরে প্রকাশ করা হয়েছে, এটা ভুল।
আবুল বারাকাত বলেন, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের বেশি হবে না। সামনের দিন আরও (বাংলাদেশের) খারাপ হবে। কারণ পিছনের দিকে অর্থনীতিতে যে ঘটনা ঘটেছে তার রেশ পাওয়া যাবে এক দুই বছর পরে। অর্থাৎ ভবিষতের প্রবৃদ্ধি আরও খারাপ হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, আইএমএফসহ সব দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিচ্ছে, তাতে একটি বার্তা পরিষ্কার, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে। এটি আশাবাদী হওয়ার মতো। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে। হয়তো প্রবৃদ্ধির সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। গত এপ্রিল-মে মাসের কঠোর বিধিনিষেধের পর সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন সংস্থার প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে।
সেলিম রায়হানের মতে, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো ধাক্কা খাচ্ছে। তখন রপ্তানি ও প্রবাসী আয় নিয়ে শঙ্কা আছে। আইএমএফের পরবর্তী পর্যালোচনায় বোঝা যাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে।
গত জুনে আইএমএফের কান্ট্রি রিপোর্টেও ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন দেখানো হয়েছিল। তবে ২০২১ সালের প্রাক্কলনে সেখানে ৫.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস ছিল, এবার তা কমিয়ে আনা হয়েছে ১.২ শতাংশ পয়েন্ট।এর আগে বিশ্ব ব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে, মহামারীর ধাক্কায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। স্বল্পমেয়াদের জন্য হলেও দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা।
তবে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস প্রত্যাখ্যান করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ওই প্রাক্কলন বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান উত্তরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশ্ব ব্যাংকের এ যাবৎকালের সব প্রক্ষেপণের যদি একটি তালিকা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, তারা যে প্রক্ষেপণগুলো করে তা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।
আইএমএফ বলছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আবার ৭ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা বাংলাদেশের ২০১৭ সালের অর্জিত প্রবৃদ্ধির সমান।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্যও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল। কিন্তু মহামারীর মধ্যে দুই মাসের লকডাউন আর বিশ্ব বাজারের স্থবিরতায় তা বড় ধাক্কা খায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে ভারতের জিডিপি ১০ দশমিক তিন শতাংশ সংকুচিত হবে। এছাড়া পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি -০.৪ শতাংশ, -৪.৬ শতাংশ, ০.৬ শতাংশ, মালদ্বীপের -৮.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। নেপালের জিডিপি অপরিবর্তিত থাকবে বলে আভাস দিয়েছে আইএমএফ। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সরকারি হিসেবে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে, যদিও এই অংক আরও কম হওয়ার কথা বলে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা।
গত সপ্তাহে বিশ্ব ব্যাংক যে দক্ষিণ এশিয়া ইকনোমিক ফোকাস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন এসেছে আইএমএফের চেয়ে অনেক কম। রেজা
আপনার মতামত লিখুন :