আবিদা সুলতানা: একই দিনে দুইটা ধর্ষনের খবর পেলাম ১০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা থানার ওসি ফোনে। তাও আবার দুইটি ঘটনার ভিকটিমই বাচ্চা তবে, ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন স্থানের। ওসি জানাল যে, এর মধ্যে একটি ঘটনায় ভিকটিম বাচ্চাটি রক্তাক্ত আহত। তাকে উপজেলা হাসপাতাল থেকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে রেফার্ড করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই মনটা খারাপ হল। ওসির কাছে বিস্তারিত জেনে নিয়ে ফোনেই ভিকটিম বাচ্চাদের চিকিৎসা ও মেডিকেল টেস্টর ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলাম। পৃথক দুইটি মামলা দায়ের হলো এবং অভিযুক্ত আসামীদেরও গ্রেফতার করা হলো।
চার পাঁচ দিন পর অফিসে কাজ করছি এমন সময় ওসি হাতিবান্ধা ফোনে জানাল দুইটি ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনার ভিকটিম লালমনিরহাট সদর হাসপালে চিকিৎসা শেষে কোর্টে ২২ ধারার জবানবন্দীও দিয়েছে, চাইলে আমি এখানেই তার সাথে কথা বলতে পারি। বললাম “ঠিক আছে পাঠান”। তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে ভিকটিমের নানীসহ আনুমানিক দশ বছরের ফুটফুটে একটি বাচ্চা আমার অফিসে এল। আমি তাকে আমার কাছে ডাকলাম। অন্য দশটা বাচ্চার মতই স্বভাবিকভাবেই কাছে এল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে অস্থিরতা স্পষ্ট। চারদিকে অুসন্ধিৎসুভাবে ঘুর্ণায়মান যেন তার চোখের মনি। মনে হলো যেন সবই দেখছে কিন্তু কিছুই দেখছে না। বললাম তোমার নাম কি? বলল ‘রিমা’(ছদ্মনাম)। আবার বললাম “কেমন আছ?” বলল “ভাল”। আমি রিমাকে চকলেট দিলাম। কিন্তু তার চোখের সেই দৃষ্টি দেখে আর কোন প্রশ্ন করতে মন সায় দিল না। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বললাম ঠিকআছে, নিয়ে যান, আমি মামলার তদারকীর জন্য ঘটনাস্থলে যাব।” বিভিন্ন ব্যস্ততায় বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কিন্তু রিমার চোখের সেই দৃষ্টি আর ভুলতে পারি না; কেমন আমার গা ঘেসে মেয়েটি দাড়িয়ে ছিল!
ঘটনাটি এরকম- গত ৯ এপ্রিল ২০২০ তারিখ বিকাল অনুমানিক ৫.৩০ এয় রিমা হাতীবান্ধা শাহ্ গরীবুল্যাহ মাজারের পিছনের মাঠে ছাগল আনতে গেলে মোঃ মাসুদ হোসেন (২৫) (ছদ্মনাম) সেখান থেকে তাকে ডেকে করোনার কারনে বন্ধ মাজার সংলগ্ন জনশূণ্য হাতীবান্ধা শাহ্ গরীবুল্যাহ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ভিতরে একটি কক্ষের ভিতরে নিয়ে ধর্ষন করে। রিমা অসুস্থ্য হয়ে কান্নাকাটি ও চিৎকার করলে তাকে ভয়ভীতি দেখায় এবং তার হাতে ষাটটি টাকা গুজে দেয়! মাজারের মাঠে থাকা ছাগল নিয়ে ভিত অসুস্থ্য রিমা কোন রকমে তার নানার বাড়িতে যায়। ধর্ষনের কারনে রক্তে তার পরনের ছেলোয়ার ও গায়ের জামা ভিজে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের দাগ লাগে। বাড়িতে গিয়ে কাপতে কাপতে মাটিতে পড়ে যায়। পরে তার নানা ও অন্যন্য আতœীয়স্বজন জিজ্ঞাসা করলে ঘটনার কথা বলে। প্রথমে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে লালমনিরহাট সদর হাসপালে ভার্তি করা হয়।
বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে পনের বিশ দিন পর মামলা তদারকীর জন্য যাওয়া হলো। পাটগ্রাম থানার আরো বেশ কয়েকটি মামলার তদারকী শেষ করে হাতিবান্ধায় যখন সেই ঘটনাস্থল শাহ্ গরীবুল্যাহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌছাঁলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। স্বাভাবিক নিয়মেই ওসি তদন্তকারী কর্মকর্তা আর মামলার বাদী রিমার নানা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকারই কথা কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম রিমা সুন্দর নতুন একটা জামা পড়ে বেশ সেজে গুজে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। যেন তার বাড়িতে অতিথি এসেছে, এমনি ভাব করে আমাকে দেখে এগিয়ে এল। আমি বললাম “আরে তুমি এসেছ কেন?” রিমা হাসল বলল “আপনি এসেছেন।” সে বেশ স্বাভাবিক। বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে”। যে কক্ষে তাকে ধর্ষন করা হয়েছে সেখানে গেলাম। সেখানে স্তুপ করে রাখা ছালার উপর ফেলে রিমাকে .. নাহ! আর ভাবতে পারি না!!!!!
এতটা জানোয়ার কী করে মানুষ হতে পারে! ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা; যার চোখ জুরে রাজ্যের অনুসন্ধিৎসা, তার কী এই অভিজ্ঞতাই প্রাপ্য ছিল?
বের হয়ে এলে সে আগের মতই আমার গা ঘেষে দাড়ায়। আমার মনে হয় সে যেন আমার মাঝে আশ্রয় খোঁজে। তবে এবার তাকে সে বেশ স্বাভাবিক আর খুশি দেখে আমার একটু ভাল লাগে।
রিমার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “কী? বড় হয়ে কী হতে চাও?” আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, “পুলিশ”! ফেসবুক থেকে
পরিচিতি: আবিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার, লালমনিরহাট
আপনার মতামত লিখুন :