রকি আহমেদ: [২] বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। এতে বিপদে পড়েছেন পোশাক ও মেশিনারিজ খাতের উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। করোনার কালো থাবায় দেশের বড় কাপড় পাইকারি বাজার রাজধানীর ইসলামপুর ও মেজিনারিজ পাইকারি বাজার নবাবপুরে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ব্যবসায়ীরা বলছেন করোনায় নেই আগের তুলনায় ৭৫% এর বেশি বিক্রি।
[৩] রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ কাপড়ের পাইকারি বাজার ইসলামপুর। প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত ক্রেতারা তাদের পছন্দের দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রকার শাড়ি, লুঙ্গি, ওড়না, থ্রি-পিস, গামছা, বিছানার চাদর, তোয়ালে, মশারি ও বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড় পাইকারি দরে কিনতে ভিড় জমান এখানে। উৎসব আসলে দেশের পরিচিত এ পাইকারি বাজারে যেন পা রাখার জায়গা থাকে না।
[৪] বছরের দুই ঈদে ইসলামপুরে বড় অঙ্কের বেচাকেনা হতো। কিন্তু করোনার লকডাউন থাকায় রমজানের ঈদে সপ্তাহখানেক মার্কেট খোলা ছিল, তবে বেচাকেনা ছিলনা। কুরবানীর ঈদে সীমিত পরিসরে মার্কেট খোলা থাকলেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এলাকা থেকে পাইকার ক্রেতারা আসতে পারেনি বলে পূর্বের ঈদগুলোর ১০ ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয়নি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। করোনায় বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষের আয় কমে যাওয়ায় ব্যবসার এমন খরা পরিস্থিতি। কিন্তু অধিক মূল্যে দোকান ভাড়া, গোডাউন ভাড়া নিয়ে বেচাকেনা তেমন না হওয়ায় প্রতিদিনই লোকসান গুণতে হচ্ছে কাপড় ব্যবসায়ীদের। ইসলামপুরে দেশীয় কাপড়ের পাশাপাশি চায়না, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, কোরিয়া,
জাপান ইত্যাদি দেশ থেকে পোশাক খাতের বিভিন্ন কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আসতো। কিন্তু করোনার কারনে এখনো এই ফ্লাইটগুলো বন্ধ আছে।
[৫] সরেজমিনে ইসলামপুর ঘুরে জানা যায়, এখানে বেচাকেনা কম থাকায় পূর্বের মালগুলো স্টক হয়ে আছে, আবার সেগুলোর ডিজাইনও পুরাতন হয়ে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে বাজারে চালাতে কষ্টকর হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক বলে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা অল্প-স্বল্প ইসলামপুর আসছে। তাদের কাছে বিদেশি দামি মালের চাহিদা কমছে, দেশি কমদামী কাপড়ের টুকটাক চাহিদা আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। জানা যায় ইসলামপুরে ১৪০ টির বেশি মার্কেটে আনুমানিক ১০ হাজার দোকান আছে। করোনার লকডাউনে এগুলো বন্ধ ছিল।
[৬] বর্তমানে ব্যবসায়িক খরায় বড় দোকান ছেড়ে ছোট দোকান নিয়েছে। অনেকে আবার কাপড় ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছে। কাপড়ের ব্যবসা হারিয়ে শরীফ নামের একব্যক্তি এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা ভ্যান চালানোর নতুন পেশায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। জলিল এন্টারপ্রাইজের এক কর্মচারী বলেন, “কম বিক্রি বলে অনেক মহাজন কর্মচারী ছাঁটাই করছেন। আগে যে দোকানে ৫ জন কর্মচারী ছিল, এখন সেখানে ৩ জন। আগে কেউ ১৫ হাজার বেতন পাইলে এখন ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতে হচ্ছে।” গুলশান আরা সিটি মার্কেটের আয়ান ফেব্রিক্সের মালিক টিপু সুলতান বলেন, “বছরে ২টা ঈদে আমাদের বেচাকেনা জমজমাট থাকে। সেই আয় দিয়ে আমরা বাকি মাসগুলোতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সপ্ন দেখি। কিন্তু এবার করোনা ও বন্যা এক ভয়াবহ চিত্র দেখিয়েছে। ব্যবসা নেই কিন্তু দোকানভাড়া, গোডাউন ভাড়া,কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল ও আনুষঙ্গিক বিল চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে আমাদের বস্ত্র ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ১ মাসের ভাড়া মওকুফ করেছে।
[৭] ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী মালিক সমিতির ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, “করোনাকালীন সময়ে বস্ত্র ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সমিতির নেতারা এক হয়ে সকল ব্যবসায়ীদের ১ মাসের ঘরভাড়া ও গোডাউন ভাড়া মওকুফ করেছি। আশা করি খুব শিঘ্রই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। সবাই যাতে স্বাস্থবিধি মেনে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালায় সেই নির্দেশনাও দিয়েছি ব্যবসায়ীদের।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের যারা বিদেশ থেকে ইনপোর্ট করছে
তারাও বড় লোকসানে আছে। হাজার টাকার শিপিং বিল এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। সরকার যদি শিপিং বিল কিংবা পোর্ট বিল ৫০ শতাংশ হলেও কমানোর জন্য যদি সরতার আর্থিক ভাবে সহায়তা করা করে তাহলে ব্যবসায়ীরা মুক্তি পাবে।”
[৮] অন্যদিকে রাজধানীর নবাবপুরে গড়ে উঠেছে দেশের মেশিনারিজ ব্যবসার বড় পাইকারি বাজার। এখানে শিল্প, কৃষি, যানবাহন ও বাসা বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ কিনতে সারা দেশ থেকে পাইকার ক্রেতারা ভিড় জমান। কিন্তু করোনায় নেই আগের মতো ব্যবসা। ছোট ও বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনায় বিক্রি ৭৫% এর বেশি কমে গেছে। নবাবপুরে ন্যাশনাল ট্রেডার্সে ধান ভাঙ্গানো মেশিন, শস্য ও ভুট্টা মাড়াই করা মেশিন, ঘাস ও ধান কাটা মেশিন, পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন কৃষি মেশিনারিজ যন্ত্র বিক্রি হয়। দোকানের মালিক রাফি আহমেদ বলেন, করোনায় আমাদের প্রায় ৭৫% বিক্রি কমে গেছে। আমরা ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন জেলায় ক্যাম্পেইন, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনলাইনের বিক্রির উপর জোর দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের কোন মেশিনের দাম কমেনি। আমাদের যন্ত্রপাতি বেশিরভাগ চায়না থেকে আসে। করোনায় মেশিনের উপর ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। সরকার যদি ট্যাক্স কম করতো তাহলে আমরাও কম দামে সেল করতে পারতাম।
[৯] অন্যদিকে প্লাস, স্ক্রু ড্রাইভার, ওয়েল্ডিং মেশিনসহ মিলের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিক্রি হয় নবাবপুরের জাকির মিল স্টোরে। এর ম্যানেজার ইসমাইল হোসেন জানান, আমাদের মতো ছোট দোকানের ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি সমস্যায় আছি।বিভিন জেলা উপজেলা থেকে ক্রেতারা আসছে না, তাই বিক্রি আগের চেয়ে অর্ধেকের নিচে চলে গেছে। কিন্তু ঘরভাড়া কমানো হয়নি, অনেকে কর্মচারী ছাঁটাই করেছে, আমাদেরও করার চিন্তা আছে।
[১০] অন্যদিকে বিদ্যুৎ এর যাবতীয় ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র যেমন সকেট, হোল্ডার, ব্রেকার, ওভারলোড, রিলে, ফ্যান, বাল্প, লাইট, ক্যাবল বিক্রি হয় নিউ জননী ইলেক্ট্রনিক স্টোরে। এর মালিক জাবেদ হোসেন বলেন, লকডাউনে ২মাস ১৫দিন একেবারে বন্ধ ছিল। এখন চালু হলেও বিক্রি নেই। ব্যবসা একদম স্থবির হয়ে গেছে। তবে আশা করোনা চলে গেলে খুব শিঘ্রই ব্যবসা আগের মতো হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সব যন্ত্র চায়না থেকে আসে। আমদানীকৃত যন্ত্রের উপর সরকার ট্যাক্স কমালে ভালো হতো।