কাকন রেজা: শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রীকে। তিনি অন্তত বুঝতে পেরেছেন দেশে কোভিড সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থাটি। ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। এই মহামারিতে এই একটি মন্ত্রণালয়েরই সিদ্ধান্ত ছিলো মোটামুটি সঠিক। যদিও প্রথম দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কিছুটা দেরী হয়েছিলো। ছাত্রদের দাবির মুখে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো তখন। সেই সময়টুকু ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ মহামারিকালীন এ পর্যন্ত উৎরে গেছে। অনেকে অবশ্য মুখ গোমড়া করেছেন ছুটি বাড়ানোতে। বিশেষ করে কোচিংবাজ শিক্ষকদের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা হচ্ছে অগণিত গলি-ঘুপচিতে গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন নামক বেসরকারি স্কুলগুলোর। শিক্ষার নামে পকেট কাটার ব্যবসা যারা চালু করেছেন তারা সবাই রয়েছেন বিপাকে। তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের জীবনের তুলনায় মূল্যমান বেশি বাণিজ্যের।
সেদিন শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে হেসে অনেকটা এভাবে বললেন, ‘আপনারা মহামারি কবে শেষ হবে জানিয়ে দিন, আমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিব।’ এই কথাটার পেছনে অসম্ভব রকম দায়িত্ববোধ লুকিয়ে রয়েছে। গত কদিনে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লকডাউন করে দিয়েছে। কারণ তাদের ওখানে সংক্রমণ বাড়ছে। তারা অন্তত শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। যে দক্ষিণ কোরিয়া করোনা নিয়ন্ত্রণে এখন সফলতা দেখিয়ে আসছে, তারাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে নারাজ। অথচ আমাদের কেউ কেউ বন্ধ রাখার প্রশ্নে অসন্তুষ্ট। বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। ঢাকায় সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে সারাদেশে। এখন প্রায় ঘরে ঘরে করোনা রোগী। আমার নিজের অনেক আত্মীয়-স্বজন আক্রান্ত হয়েছেন। বিপরীতে রাস্তা-ঘাটে দৃশ্যমান অবস্থা উল্টো। মনে হচ্ছে দেশে করোনা নেই। কোথাও কোনো বাধা-নিষেধ নেই, সেই আগের মতো স্বাভাবিক জীবন। ‘নিও-নর্মাল’ নয়, ‘ওল্ড-নর্মাল’। ব্যতিক্রম শুধু দু’একজন মাস্ক পড়া মানুষ। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ বাধ্য করানোর মতন কোনো কার্যক্রম নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী করছে জানি না। তাদের সকল কার্যক্রমই এখন অদৃশ্য।
বাড়ি বাড়ি মানুষ জ্বরে ভুগছে। কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তারপরেও হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক চিন্তা আসন গেড়ে বসেছে। অনেকে বাড়িতেই মারা যাচ্ছেন। হয়তো হাসপাতালে আনছেন একেবারে শেষ সময়। মানুষ টেস্টও করাচ্ছেন না। টেস্ট করাতে দুদিন, রিপোর্ট পেতে আরও তিন-চার দিন। ততোদিনে আক্রান্ত মানুষের অবস্থা শোচনীয়। দেরীতে চিকিৎসা শুরু হওয়ায় তারা আরও বিপাকে পড়ছেন। ফলে বেশিরভাগ মানুষ পরীক্ষাই করাচ্ছেন না। বাড়িতে ৪ জন জ্বরে আক্রান্ত। একজনের টেস্ট করাচ্ছেন। পজেটিভ হলে সবাইকে পজেটিভ ভেবে পরিচিত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবের খাতায় উঠছে ওই একজনেরই নাম। এভাবেই আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসেবে কমে যাচ্ছে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই কার্যক্রমটি আদৌ চালু রয়েছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে। আক্রান্ত পরিবারের বাড়ি লকডাউন করা হলেও তদারকি না থাকায় সে লকডাউনও বৃথা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে লাল নিশান টানানো থাকলেও সে বাড়ি থেকে অবাধে বের হচ্ছে মানুষ, যাচ্ছেও। সব মিলিয়ে মহা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এরমধ্যে একমাত্র ভরসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়টিই। সব কিছু যেভাবে ‘খুল্লাম খুল্লা’ করে দেয়া হয়েছে, সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দিলে সর্বনাশের ষোল কলা পূর্ণ হতো।
পুনশ্চ: অবশেষে চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে রাজি হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অনেক খারাপ খবরের মধ্যে এটা সত্যিই একটা ভালো খবর। ট্রায়াল নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির শিকার হয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশে। শ্রিংলার বাংলাদেশ সফর অন্তত তাই জানিয়ে দিয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ট্রায়ালে সম্মতি দেওয়াটাও বিশাল একটা ব্যাপার। বলা হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা ট্রায়ালে অগ্রাধিকার পাবে। পাক। তাদের ব্যাপারে দ্বিধা নেই। গণমাধ্যমকর্মীরাও যেন সে অধিকার থেকে বাদ না যায়। অন্যান্য ফ্রন্ট-লাইনার’দেরও যেন ট্রায়ালে যুক্ত করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন :