শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১০:৪৯ দুপুর
আপডেট : ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১০:৪৯ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমজাদ আকাশ: শিল্পী মুর্তজা বশীর, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে যিনি শিল্পের পথে হেঁটেছেন

আমজাদ আকাশ: স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই বাম রাজনীতির যুক্ত হয়েছিলেন। রাত পালিয়ে দেয়ালে দেয়ালে লিখতেন বিপ্লবী স্লোগান। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। স্লোগানমুখর সময়ে তিনি নিজেকে আঁকিয়ে হিসেবে আবিষ্কার করলেন। দেখলেন, ভালো ছবি আঁকতে পারেন। পার্টিও তা-ই দেখলো। মেট্টিকুলেশনের পর তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হলো, আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে। তাঁর মনেও চিত্রশিল্পী হওয়ার সুপ্ত বাসনা। সময়টা ১৯৪৯। মুর্তজা বশীর শিল্পী হওয়ার অসীম স্বপ্ন নিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের নের্তৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আর্ট স্কুল চালু হয়েছে। একটি ব্যাচ অলরেডি ভর্তি হয়ে ক্লাস করছে। মুর্তজা বশীর তার পিতা জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে জানালেন যে, তিনি আর্ট স্কুলে পড়তে চান। পিতা রাজি নন, কিন্তু পুত্র আর্ট স্কুলে পড়বেনই। পুত্র আজন্ম বিদ্রোহী। শুরু হলো পিতা-পুত্রের ইচ্ছের লড়াই। পুত্রেরই জয় হলো। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই নিজের পরিচয় তৈরি করবেন। পিতার খ্যাতির বলয়ের বাইরে গিয়ে নিজের যোগ্যতায় রচনা করবেন নিজের খ্যাতি। প্রথমেই নজর দিলেন নিজের নামের দিকে। পিতার দেওয়া নাম মুর্তজা বশীরুল্লাহ থেকে উল্লাহ বাদ দিলেন। হয়ে গেলেন মুর্তজা বশীর। বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে এক অনন্য নাম।

একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাবা কি সহজে রাজি হয়েছিলেন? বললেন, আরে না, বাবা তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি আমাকে শিল্পীদের করুণ জীবন নিয়ে নানাভাবে বুঝিয়েছেন, আমি যেন আর্ট স্কুলে ভর্তি না হই। তিনি আমাকে বললেন কী, দেখো বশিরুল্লাহ শিল্পী জীবন ভয়াবহ কষ্টের। এ রকম নিচু জীবন তুমি যাপন করো আমি তা চাই না। কিন্তু আমার মনে তো শিল্পী হওয়া ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় চিন্তা ছিল না। শিল্পী তো আমি হবোই। বাবাকে আমি তা-ই বললাম। অবশেষে বাবা রাজি হলেন। শিল্পকলা বিষয়ে অনেক বই বাবার সংগ্রহে ছিল। সেগুলো আমাকে দিলেন। যা আগে আমার দেখার অধিকার ছিল না।

রাজনৈতিক কারণেই মুর্তজা বশীর আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ভর্তি হওয়ার পর তা আরও জোরেসোরে চালাতে লাগলেন। বগুড়া করোনেশন স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, তিনি বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটি মিছিল এবং মিটিং আয়োজনে কাজ করেছিলেন। ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় ৫ মাস কারভোগ করার পর মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে তিনি ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারি ২২ তারিখের গায়েবানা জানাজাতেও অংশ নেন এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করলে পলাতক থাকতে বাধ্য হন। তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুনগুলো দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে হাসান হাফিজ সংকলিত প্রথম কবিতা সংকলেন ইলাস্ট্রেশন করেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। এছাড়াও বাংলা ও বাঙালির প্রতিটি স্বাধীকার আন্দোলনে শিল্পী মুর্তশা বশীর সংক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫৪ সালে আর্ট স্কুলের ৫ বছর মেয়াদী চারুকলা শিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকার নবাবপুর স্কুলে কিছুদিন চারুকলা শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে চারুকলা বিষয় উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে পাড়ি জমান ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তার শিক্ষক। ফিগারের সরলীকরণ ও স্বল্প রঙ ব্যবহারের পদ্ধতি বশীরকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে তিনি এঁকেছেন পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি। অ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য ইত্যাদি তাঁর এ সময়কার উল্লেখযোগ্য কাজ।
মূলত ফ্লোরেন্সেই মুর্তজা বশীরের শিল্পী জীবনের নতুন বাক তৈরি হয়। ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পকলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন এ সময়ে। শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে শিল্পকলার নতুন আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালীয় চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে আদিমতার আন্দোলন নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল এই শিল্পী গ্রুপ ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে যৌথ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।

ফ্লোরেন্সে শিল্পী মুর্তজা বশীর ফ্রেসকোর পাঠ নেন অধ্যাপক কাপুচিনির কাছে। ফ্রেসকো থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা তিনি পরবর্তী জীবনে তাঁর চিত্রকলায় ব্যবহার করেন। গড়ে তুলেন শিল্পের এক নতুন ধারা। শিল্পী তার নাম দিয়েছিলেন ট্রান্সপারেন্সিজম বা স্বচ্ছতাবাদ। এই পদ্ধতিতে ক্যানভাসে রঙের একটি লেয়ারের ওপর আরেকটি লেয়ার ব্যবহার করা হয়। রঙকে পাতলা করে এমন ভাবে অন্য লেয়ারের ওপর প্রলেপ দেওয়া যেন, নিচের লেয়ারটিও দেখা যায়। এতে চিত্রতলে বিষয়ের একটি রহস্য তৈরি হয়। চিত্রতলে রঙের এই রহস্য শিল্পরসিককে সহজেই মোহিত করে ।
১৯৫৮ সালে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। স্বাধীন শিল্পী হিসেবে কাজ করেন দীর্ঘ বছর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৭৬ সালের মার্চের মধ্যে ‘এপিটাফ’ সিরিজে আরও ২০টি ছবি আঁকেন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন। ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। ১৫ আগস্ট ২০২০ সালে বাংলাদেশি এই শিল্প মহীরুহের জীবনাবসান হয়।

লেখক : চিত্রশিল্পী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়