শিরোনাম
◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল

প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট, ২০২০, ০৭:২৯ সকাল
আপডেট : ১৫ আগস্ট, ২০২০, ০৭:২৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী, প্রবাদপুরুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা

ড. আতিউর রহমান : বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির শুরু কিশোর বয়সে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে, কিন্তু তিনি নিজেই একদিন সকলকে ছাড়িয়ে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের সাড়ে সাতকোটি মানুষের ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক আদর্শে তিনি স্থিত হন নিপীড়িত-নির্যাতিত এই জাতিকে উদ্ধারের দৃঢ়সংকল্পের মধ্যে। শত শত বছরের বিদেশি-বিভাষী শাসনের যাতাকলে পড়ে এই জাতি যে তাদের আত্মবিশ্বাস একেবারে হারাতে বসেছিল, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হতে তারা আরও মাটি সংলগ্ন হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল অস্তিত্বের দিক থেকে সেই কথাটাই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতা। মধ্যবিত্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু নেমে গিয়েছিলেন নিম্নবিত্ত অভাজনদের কাতারে হৃদয়ের টানে তাদের মুক্তির আকাক্সক্ষায়। মনে হয় না যে, সারাজীবনে একটি দিনও তিনি ব্যয় করেছেন এই অভাজনদের কথা না ভেবে। এমনকি জেলখানার ভিতরে দূর্বিসহ জীবনের মধ্যে থেকেও নিজের কথা না ভেবে সাধারণ কয়েদিদের দুঃখ দুর্দশার লাঘবের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দেন-দরবার করেছেন। তাদের জন্যে পিটিশন লিখেদিয়েছেন। বাইরে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের কথা ভেবেছেন। ভেবেছেন সাধারণ মানুষের কথা যাদের নায্য দাবি আদায়ের জন্য তিনি জেলে থাকতেন প্রায়ই। কারাগারের রোজনামচায় তিনি ১৯৬৬ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার লিখেন, ‘বন্যা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। চাউলের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা মন হয়ে গেছে। জনগণের আর শান্তি নাই। শান্তি চেয়ে আনা যায় না, আদায় করে নিতে হয়। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। অত্যাচারী ভয় পেয়ে যাবে।’ [কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ২০১৭, পৃষ্ঠা ১১৭] জেলেই আছেন, শাসকের খড়গ কৃপাণ মাথার উপর ধরাই আছে। তবু তিনি নির্ভিক তার আহ্বানে-কাতর মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূও করার জন্য। নিপীড়িত বাঙালির এমন দরদি সত্যিই হাজার বছরের মধ্যে আর পাওয়া যায়নি।

তাই তো আমাদের বলতে একটুও দ্বিধা হয় না যে বঙ্গবন্ধুই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত গতিতে চালাতে শুরু করে। কিন্তু দমাতে পারেনি তাকে। আত্মপরিচয়ের অহংকারে তিনি এতটাই নির্ভিক হয়ে উঠেছিলেন ক্রমে যে এই জাতির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হননি। স্বাধীনতা কিংবা পাকিস্তান ভাঙার কথাটা তিনি ভাবেননি শুরুতে কিন্তু আপামর জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে তিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো অনঢ়। তার ছয় দফা সেই কথাই বলে। ছয় দফার মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববাংলার বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্য দিয়েই সুষম সামাজিক কাঠামো গঠন সম্ভব বলেই তিনি মনে করতেন। এদেশের মানুষ তাকে কতোখানি ভালোবাসতেন, মানুষকে তিনি কতোটা আশাবাদী করতে পেরেছিলেন, জাগরণের মন্ত্রে আপামর জনসাধারণ কতোটা দীক্ষিত হয়ে ছিল তার প্রতীকি প্রকাশ ঘটে ১৯৭০-এর নির্বাচনে। হ্যামিলনের এই বংশীবাদক তার মুক্তিবাণীর সুরে গোটা জাতিকে এককাতারে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। তার পরের ইতিহাস দ্রুত পট পরিবর্তন করে একটা অমোঘ নিয়তির দিকে নিয়ে যায় এই জাতিকে। কী অসাধারণ শক্তি তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন এই পিছিয়ে-পড়া, প্রায় নিঃশেষিত শক্তির এই জাতির মনে যে তার অনুপস্থিতিতে তারই আদেশকে নিজেদের মুক্তি মোক্ষম বাণী হিসেবে গ্রহণ করে প্রশিক্ষিত সমরাস্ত্রে সজ্জিত একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় বুক চিতিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধটাকে থামানোর জন্য একদিকে যেমন এদেশের মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হয় তেমনি যুদ্ধ বন্ধের জন্য পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধুর ওপর বার বার বন্দুক তাক করা হয়। তাঁকে ফাঁসির দড়িতে বাঁধার হুমকি আসতে থাকে। জেলখানার ভেতরেই কবর খোঁড়া হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন অনঢ়। আপোষহীন। বন্দুকের মুখেও তিনি নিজের জীবনের পরোয়া না করে এই জাতির কথাই ভেবেছেন।
স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। ফিরে এসে তিনি এটা মনে করেননি যে তার কাজ শেষ। তিনি ভ‚খÐগত এই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য দেশ গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যে মানুষগুলোর সামগ্রিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আসছিলেন তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে রেসকোর্সের মাঠে আবার জনতার সামনে দাঁড়ান তিনি। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গত দশ মাসে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরাণ করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেব বলছি- যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তা হলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। তোমরা, আমার গেরিলা ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছো। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন।’ [বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, দৈনিক বাংলা, ঢাকা, ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২]। তিনি সেদিন বলেছিলেন যে আমাদের আছে ষংগ্রামী মানুষ ও উর্বও মাটি। তাই ভয় কীসের? বাঙালি হিসেবে নিজের আত্মপরিচয়ের অহংকার না থাকলে এমন উদাত্ত আহ্বান জানানো যায় না। এতো সহজে বলা যায় না, ‘আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি’। বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী এই প্রবাদপুরুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা। ঈষৎ সংক্ষেপিত।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংকব্যাংক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়