লুৎফর রহমান রিটন: আমার শৈশবে বাংলাদেশে সবচে কমদামি কলাটির নাম ছিলো চম্পাকলা। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে চম্পাকলা ছিলো অসচ্ছ্বল বা দরিদ্র শ্রেণির। সচ্ছ্বল বা ধনাঢ্য শ্রেণির কলার নাম ছিলো সাগরকলা। গরিবরা সাগর কলা খেতেন না। তাদের জন্যে ছিলো চম্পাকলা। কলা বিক্রি হতো ডজন হিশেবে। এক ডজন সাগর কলার দামে চম্পাকলা কেনা যেতো চার-পাঁচ ডজন।
কিন্তু কানাডায় আসার পর আমি দেখলাম ঘটনা উলটো। গ্লোব-এ কানাডা নামের দেশটির অবস্থানও বাংলাদেশের মানচিত্রের একেবারেই উল্টোদিকে। কানাডার সাগর কলা রূপে অনন্য। ঝকঝকে চকচকে। কোথাও কোনো দাগ নেই। দাম গড়ে প্রতি পাউন্ড ৭০ সেন্ট। অর্গানিক হলে ২ ডলার প্রতি পাউন্ড। কিন্তু কানাডায় চম্পাকলার দাম অনেক বেশি। প্রতিপাউন্ডের দাম গড়ে সাড়ে ৩ ডলার।
মাঝে মধ্যেই আমার ইচ্ছে হয় চম্পাকলা খেতে। আমি তখন সাগর কলার চারগুণ দামে কিনে আনি চম্পাকলা কয়েক পাউন্ড। তারপর খুব যত্নে ধীরে ধীরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাই সেই মূল্যবান কলারত্ন। খাই আর ভাবী--আহারে চম্পাকলা, বাংলাদেশে তোর স্ট্যাটাস কতো নিচে! বাংলাদেশে তোর কোনো দামই নেই বলতে গেলে। কিন্তু ভিনদেশে কতো ভ্যালু তোর!
চম্পাকলার কথা মনে পড়লেই এক রাতের স্মৃতি আমাকে পেয়ে বসে।
আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকি। এক শীতের রাতে, শীতটা তখনো কনকনে নয়, রাত তখন দশটা সাড়ে দশটা, এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগনাল থেকে বায়ে টার্ণ নিতেই দেখি মুন্নু সিরামিকের দোকানের ডানপাশের রাস্তার ওপর ছেঁড়া একটা চট বিছিয়ে জীর্ণশীর্ণ শরীরের এক চাচামিয়া কিছু চম্পাকলা সাজিয়ে বসে আছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। পরিমানে চার ডজনের বেশি হবে না।
শীতের রাত বলে রাস্তায় লোক চলাচল খুব কম। তারচে কম তাঁর ক্রেতা। চাচামিয়ার বয়েস হয়তো বা ষাট কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সেটাকেই মনে হয় সত্তুরোর্ধ। অপুষ্টির কারণে ভাঙাচোরা এব্রোখেব্রো গাল। শরীরটা বেঁকে খানিকটা নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে।
রিকশা থেকে নেমে আমি জিজ্ঞেস করলাম--কি চাচা আপ্নের চম্পাকলার খবর কি?
অনেকক্ষণ পর একজন সম্ভাব্য ক্রেতা পেয়ে কিছুটা উৎফুল্ল চাচামিয়া। কিন্তু চম্পাকলার দাম জিজ্ঞেস না করে চম্পাকলার খবর কি জিজ্ঞেস করায় চাচামিয়া খানিকটা দ্বিধায় পড়েছেন আমি ক্রেতা নাকি খামোখাই দিগদারি পেরেশানি করছি তাঁকে।
আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম--চাচা আপ্নের চম্পাকলার ডজন কতো?
এইবার খুশি হলেন চাচা--ডজন চইদ্দ ট্যাকা। পোন্রো ট্যাকাই বেঁচনের কথা।
আমি খানিকটা অবাক হবার ভান করি--চ ই দ্দ ট্যা কা!
চাচা দ্রুত কমিয়ে ফেললেন রেট--আপ্নে বাবা যদি ন্যান বারো ট্যাকাই দিয়েন। নিবেন এক ডজন?
চাচার চোখে বিপুল উৎসাহ--শীতের রাইত বাবা। বাড়িত যাইতে হইবো। কিন্তু এই কলাডি না বেঁইচ্চা যাই ক্যাম্নে!
আমি বললাম--ঠিকাছে, সবগুলি নিলে কতো?
এইবার চাচার খুশি দেখে খুশি হয়ে উঠি আমিও। একটু ঝুঁকে পায়ের জুতোয় ভর দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসি আমি--বলেন চাচামিয়া সবগুলা একসঙ্গে নিলে দাম কতো পড়বো?
মহাউৎসাহে কলাগুলো গুণতে লেগে গেলেন চাচা। গুণেটুনে বললেন--তেতাল্লিশটা আছে বাবা। পঞ্চাশ ট্যাকাই হয়। কিন্তু আপনে চল্লিশ ট্যাকাই দিয়েন বাবা। এর কম দিলে তো বাবা লোকসান।
চাচার চোখে আকুতি--নিবেন বাবা?
আমার মনটা বিষণ্ণতায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। সত্তুরোর্ধ এক বৃদ্ধ ছিন্ন পোশাকে এই শীতের রাতে মাত্র কয়েকটা কলা বিক্রি হয়নি বলে এলিফ্যান্ট রোডের রাস্তার ওপরে কী রকম সংগ্রামটাই না করছেন!
বললাম--দ্যান চাচা।
চাচার খুশি দেখে কে!
খুব যত্ন করে কলাগুলো তিনি একটা পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে তুলে দিলেন আমার হাতে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ওয়ালেট খুলে তাঁর হাতে একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলাম। নোটটা নিয়ে তিনি চল্লিশ টাকা রেখে বাকিটা আমাকে ফেরৎ দেবার জন্যে কোমরের লুঙ্গির খুঁট থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো কিছু ভাঙতি টাকা বের করে গুণতে লাগলেন।
আমি বললাম--গোণাগুন্তির দরকার নাই চাচা। বাকি ট্যাকা দিয়া আপ্নে কিছু কিন্না খাইয়েন।
আমার কথায় হতচকিত চাচা--কী কইলেন?
আমি রিপিট করলাম--বাকি ট্যাকা দিয়া আপ্নে কিছু কিন্না খাইয়েন। বলেই আমি হাঁটা দিতে উদ্যত হলাম।
হতভম্ব চাচা কোমরে লুঙ্গির খুঁটে টাকাগুলো রেখে কেমন অস্ফুট কণ্ঠে ডেকে উঠলেন--বাবা...
আমি তাঁর দিকে তাকাতেই দেখি তিনি আমাকে তাঁর কাছে যেতে আহবান করছেন দুই হাত উপর দিকে তুলে।
দুই কদম পিছিয়েই আমি আমার ডান হাতটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু দেখলাম তিনি ইশারায় আমার হাত না, মাথাটা এগিয়ে দিতে বলছেন।
আমি নিচু হয়ে ঝুঁকে তাঁর দিকে মাথাটা বাড়িয়ে দিলাম। তিনি তাঁর দারিদ্র্যজর্জর কম্পিত হাতে আমার মাথায় আশীর্বাদ বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারি না। কারণ অপ্রত্যাশীত সামান্য ভালোবাসার উত্তাপে সত্তুরোর্ধ বৃদ্ধের চোখ দু'টি তখন জলে টলটল করছে।
অটোয়া ০৪ আগস্ট ২০২০
ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :