শিরোনাম
◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের 

প্রকাশিত : ২৩ জুলাই, ২০২০, ০৭:৩৬ সকাল
আপডেট : ২৩ জুলাই, ২০২০, ০৭:৩৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ফাহিম সালেহর বেঁচে থাকা জরুরি ছিলো : তসলিমা নাসরিন

ডেস্ক রিপোর্ট : ফাহিম সালেহ অল্প বয়সে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন, ২.২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন নিউইয়র্ক শহরের অভিজাত এলাকায়- এসব আমাকে আকর্ষণ করেনি। আমাকে আকর্ষণ করেছে তাঁর তুখোড় মেধা, তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি, এবং প্রচ- উদ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করাটা। খুব ছোট আকারে শুরু করেছিলেন কিছু কাজ, বেঁচে থাকলে বড় কিছু হয়তো করতে পারতেন এই স্বপ্নবান যুবক। তাঁর বেঁচে থাকার খুব দরকার ছিল।

পুলিশের, বিশেষ করে নিউইয়র্ক পুলিশের তদন্তের রিপোর্ট শুনে ধারণা হয়, তাঁকে বাঁচতে দেয়নি ২১ বছর বয়সী টাইরেস ডেভন হাস্পিল। এই ছেলেকে ফাহিম একসময় সহকারীর চাকরি দিয়েছিলেন, কারণ কিছু গুণ ছিল ছেলেটির। কিন্তু গুণের চেয়ে দোষ তো এর পাহাড়-সমান। ফাহিমের এক লাখ ডলার চুরি করে ধরা পড়েছিল টাইরেস। তখন তার চাকরিটি খুব স্বাভাবিক যে, চলে যায়। ফাহিম তাকে পুলিশে সোপর্দ না করে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার পরামর্শ দেন। কোথায় টাইরেস ফাহিমের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, তা নয়, ফাহিমকে মেরে ফেলার প্ল্যান করে সে। ফাহিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে টাইরেস। ২১ বছর বয়সী ছেলের নিশ্চয়ই এটি প্রথম হত্যা। কিন্তু এমন হত্যাকা- দেখে পুলিশ বলেছিল, এ কোনও প্রফেশনাল খুনির কাজ। অনেকে বিশ্বাস করে শিশু-কিশোর তরুণ মাত্রই সৎ, নিষ্পাপ, নিরীহ, কোমল, আদর্শবাদী। কিন্তু এরা যতটা ভয়ংকর হতে পারে, ততটা ভয়ংকর বয়স্ক মানুষের পক্ষে হওয়া একটু কঠিনই। গুলশান ক্যাফেতে টাইরেসের বয়সী ছেলেগুলোই তো ছিল, কী নৃশংসভাবে ওরা জবাই করেছে মানুষগুলোকে! ধর্মের জন্য যেমন মানুষ যা কিছু করতে পারে, তেমন টাকার জন্যও। এক দল পরকালের সুখের জন্য বীভৎস কাজ করতে দ্বিধা করে না, আরেক দল দ্বিধা করে না ইহকালের সুখের জন্য বীভৎস কাজ করতে।

মনে হয় এক লাখ ডলারের দেনা থেকে বাঁচার জন্য টাইরেস হত্যা করেছে ফাহিমকে। আহ, ফাহিম যদি জানতেন এ কারণে তাঁকে মরতে হবে, তাহলে তো টাইরেসকে এক লাখ ডলার দান করে দিতেন। অথবা চুরি করার কারণে টাইরেসকে পুলিশে দিতেন। টাইরেসের জন্য ফাহিমের এই মায়াদয়া বা উদারতাটাই, এই ফেভারটাই, পুলিশে না দেওয়াটাই, ফাহিমের কাল হলো।

নিউইয়র্কের পুলিশ তিন-চার দিনের মধ্যেই খুনিকে শনাক্ত করতে পেরেছে। এরকম খুন আমাদের অঞ্চলে হলে কোনওদিনও হয়তো খুনি ধরা পড়তো না। কিন্তু একটি ব্যাপার আমি বুঝিনি, কেন ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারকে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার বলা হচ্ছে। সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার হলে টাইরেস শাস্তি কম পাবে। টাইরেস তো ফাহিমকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়েই ফাহিমের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল ব্যাগে স্ট্যানগান, ছুরি, ইত্যাদি নিয়ে। তাহলে? টাইরেসের ব্রুকলিনের বাড়িতে পাওয়া গেছে সেই আপাদমস্তক ঢেকে ফেলার কালো পোশাক, যে পোশাক পরে সে সেদিন ফাহিমের পেছন পেছন লিফটে চড়েছিল। বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত লোকদের মধ্যে তো গিজগিজ করছে বোকা গাধা, চোর বদমাশ, খুনি ধর্ষক ধর্মান্ধ প্রতারক, টেরোরিস্ট। এইসব গোবরে ফাহিম সালেহ ছিলেন এক পদ্মফুল। ওঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু পদ্মফুলটিকে অকালে ঝরিয়ে দিল একটা জঘন্য কুৎসিত লোক। হত্যাদৃশ্যটি কল্পনা করলেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যত কিছু আমরা জানি, তার মধ্যে সবচেয়ে কম জানি মানুষের মস্তিষ্ক। এর ভিতরে কী হয় না হয়, আমরা প্রায় কিছুই জানি না। খুনি টাইরেস ডেভনের কথাই ভাবি না কেন। ওই ভয়ংকর খুনটি করে সে দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিল। শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেনি। বরং খুনের জায়গা থেকে খুব দূরে নয়, এমন এক পাড়াতেই বাস করছিল। যাকে খুন করেছে, তাঁর ক্রেডিট কার্ড দিয়েই বেলুন কিনলো গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিনে দেবে বলে। যাঁকে খুন করেছে, তাঁর ক্রেডিট কার্ড দিয়েই কিনেছে তাঁর শরীর কেটে টুকরো টুকরো করার জন্য ইলেক্ট্রিক করাত, কিনেছে খুন হওয়া মানুষটির ঘর থেকে নিজের আঙুলের যত দাগ আছে, সব মুছে দেওয়ার জিনিসপত্র, হ্যান্ডি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। ভেবেছিল, শরীর কাটা টুকরোগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে যাবে বাইরে, কোথাও নিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে, বা মাটিতে পুঁতে ফেলবে। এমনভাবে জায়গাটা সাফ করে দেবে যে কেউ বুঝতেই পারবে না অ্যাপার্টমেন্টে কোনও খুন হয়েছে। কিন্তু চালাকিটা কাজে লাগেনি, কেউ বেল বাজিয়েছে শুনে সিঁড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি ভেগেছে। কিন্তু তারপরও ভয় ডর নেই। ফাহিমের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে, অথচ সে কয়েক টুকরো হয়ে মৃত পড়ে আছে নিজের ঘরে। পুলিশ যে খোঁজ করবে কে তার ক্রেডিট কার্ড চুরি করেছে, কে ব্যবহার করছে, এইটুকু চিন্তা তার হয়নি। তার মা ছিল মানসিক হাসপাতালে, তাহলে সে কি তার রক্তে কিছু মানসিক রোগ বহন করছে? কিন্তু মানসিক রোগীরা তো খুব খুন করে না, খুন করে ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনালরা।

আমি জানি না ফাহিমের কেন কোনও নিরাপত্তা রক্ষী ছিল না, কেন তাঁর বাড়িঘরে আধুনিক কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তিনি রাখেননি। কোনও সিসিটিভিও তো ছিল না। লিফটের সিসিটিভিতে শুধু ছবি আসে, ভয়েস আসে না। এত দামি বিল্ডিং এর এই হাল কেন কে জানে। খুনি টাইরেস নিশ্চয়ই জানতো এসব, তাই তার জন্য সুবিধে হয়েছে সোজা ঢুকে যাওয়া, সোজা মেরে ফেলা।

ফাহিম কেন টাইরেসকে চাকরি দিয়েছিলেন টাইরেসের যখন মাত্র ১৬ বছর বয়স? সম্ভবত দয়া হয়েছিল। টাইরেসের মা মানসিক হাসপাতালে, বাবা তাকে রাখে না, আত্মীয়দের বাড়িতে বাড়িতে থাকতে হতো। এক মাসির বাড়িতে ছিল কয়েক বছর, কিন্তু মাসি তার রুক্ষ ব্যবহার আর অশ্রদ্ধা পেতে পেতে অতিষ্ঠ হয়ে পালক দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ১৭ বছর বয়স তার। টাইরেস যখন স্কুলে পড়তো, তখনই এক ক্লাসমেটের সংগে ওয়েব ডিজাইন করে পুরস্কার পেয়েছিল। সম্ভবত এই কারণেই ফাহিম তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। যতটুকু খবর পেয়েছি, টাইরেসকে খুব ভালো বেতন দিতেন ফাহিম, সাহায্য করার জন্যই দিতেন, যেন আত্মীয়-স্বজনের ঋণগুলো মেটাতে পারে। টাইরেস ফাহিমের কী কাজ করতো? ফাহিমের কুকুরটা দেখতো, ফুটফরমাশ খাটতো, ধীরে ধীরে টাকা পয়সার হিসাবগুলোও দেখতে শুরু করেছিল। একে যে কতটুকু বিশ্বাস করতেন ফাহিম! আহ, নিজের খুনিকে তিনি দুধ কলা দিয়ে পুষেছিলেন।

কাউকে যদি বেশি উপকার করো তুমি, সে তোমার পিঠে ছুরি বসাবে, ফাহিমের ক্ষেত্রে পিঠের বদলে পেটে ছুরিটা বসেছে। যে মানুষটার মনে এত ঘৃণা, যে এত বর্বর, এত নিষ্ঠুর, এত হিংস্র, সে আবার একটা হার্ট আকৃতির বেলুন কিনে বান্ধবীকে দিয়েছে। ঘৃণা এবং ভালোবাসা একই মনে সে ধারণ করতো। ওই ভালোবাসা কি সত্যিই ভালোবাসা? আমার সংশয় হয়। আমার মনে হয় বান্ধবীর কোনও কাজ যদি তার পছন্দ না হয়, অথবা বান্ধবীটি তার গর্হিত কীর্তিকলাপ কিছু ধরে ফেলে, তাহলে তাকেও সে ওভাবে কুপিয়ে মারতে পারে। এই মানুষগুলো নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে স্নেহ ভালোবাসা দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু নিজেকে কি সত্যিই তারা স্নেহ ভালোবাসা দেয়? হয়তো নিজের প্রতি ঘৃণা থেকেই মানুষ এতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। যে একবার খুন করে, সে বারবার খুন করতে পারে। কেউ কেউ খুন করতে বাধ্য হয়। যেমন যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকরা। সেই খুনগুলোকে বলা হয় দেশের স্বার্থে খুন করা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরে আমেরিকার কত সৈনিকের জীবন যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল! তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।

মানুষ যখন খুনের পরিকল্পনা করে এবং সত্যি সত্যি খুন করে, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে তাদের মস্তিষ্কের অন্দরমহল, কী কী পরিবর্তন হতে থাকে ওতে। মানসিকভাবে যারা অসুস্থ তাদের চেয়ে মানসিকভাবে যারা সুস্থ তারাই বেশি খুন করে। মানুষ ভালোও যেমন, মন্দও তেমন। ভালো হওয়ার শিক্ষা নিয়ে, আমরা যত ভালো, তার চেয়েও বেশি ভালো হই। আর বনের জন্তু জানোয়ারগুলো যারা খুব ভালো, তারা কিন্তু আমাদের মতো ভালো হওয়ার শিক্ষা পায় না, শিক্ষা ছাড়াই তারা খুব ভালো।

বাঙালি এক প্রতিভাবান তরুণকে অকালে বিদেয় নিতে হলো। পৃথিবীতে যাঁরাই প্রতিভাবান, যাঁরাই পৃথিবীকে আরও সুন্দর এবং বাসযোগ্য করার জন্য নিরবধি কাজ করছেন, তাঁরা সতর্ক থাকুন, নিরাপদে থাকুন। আরও বহু বছর আপনাদের বেঁচে থাকাটা জরুরি। আমাদের মতো অগণন সাধারণ মানুষদের জন্য জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়