শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও

প্রকাশিত : ১৫ জুলাই, ২০২০, ১১:৫৩ দুপুর
আপডেট : ১৫ জুলাই, ২০২০, ১১:৫৩ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্বপ্না রেজা: অমানুষের ভীড়ে মানুষের সন্ধান

স্বপ্না রেজা: গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সামনে এসে দাঁড়ালো একটা রিকশা। রিকশাচালক জানতে চাইলো, কোথায় যাবেন। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি বিধায় খুব দ্রুত জানালাম রিকশা লাগছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার দৃষ্টি রিকশাচালকের ওপর থেকে সরলো না। বয়স আনুমানিক পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ। টসবগে তরুণ। অথচ বিষন্নতার প্রলেপমাখা দুটো চোখ। সম্ভবত বেশ কদিনের ব্যবহৃত জিনসের প্যান্ট, সাদা টি-শার্ট পরে আছে। পায়ে স্লিপার। বর্ষার অবিবরত বৃষ্টির ছোয়া আছে সমস্ত শরীর জুড়ে।

মনে এক ধরনের অনুভুতি জেগে উঠলো। সাথে প্রশ্ন। বয়সে ছোট বলে তুমি সম্বোধন করলাম। ‘রিকশা চালানোটা কী পেশা, তোমার ?’ এমন প্রশ্ন সহজেই করা যায়। কারণ তাকে দেখে মনে হয় না সে একজন রিকশাচালক। রিকশার থেকে নেমে কাছে আসে। বিষাদাচ্ছন্ন চোখে হাত বুলায়। হয়তো চোখের জলকে উতলে উঠতে বারণ করে।

‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টুডেন্ট। বাবা ও মা কৃষিজীবি। টিউশনি করে পড়ালেখা, ঢাকায় থাকা খাওয়া আর বাবা-মায়ের জন্য কিছু পাঠাতাম। করোনা সবকিছুকে ওলটপালট করে দিয়েছে। টিউশনি বন্ধ। অভিভাবকরা নিষেধ করেছে পড়াতে যেতে। এখন রিকশা চালাই। রিকশা চালিয়ে দিনে তিন, চারশো আয় করে বেঁচে আছি।’

ইদানীং আকাশ আর মেঘমুক্ত থাকছে না। সূর্য তার আলো দিতে কার্পণ্য করছে বেশ। আলো আঁধারীর এক পরিবেশে মনে হলো ঝুমবৃষ্টি ঝরবে। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হলো কেনো এই ছেলেটিকে আমি প্রথম দেখায় একজন স্টুডেন্ট ভেবে নিতে পারলাম না। পরনের পোশাক, দিনমুজুরের ক্লান্ত অবয়বে ওর পরিচয় গোপন হলো। কিন্তু মানুষ চিনতে ভুল হলো কেনো আমার। এমন ভুল কী সবাই করে আজকাল মানুষ চিনতে। কী জানি। এটুকু বুঝতে পারি হয়তো বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছি। কিংবা বোধশক্তি নামক অর্জিত শিক্ষা আজ আমার বিপর্যস্ত, ক্লান্ত এবং বিব্রত।

সকালে ঘর থেকে বের হবার সময় টিভি সংবাদে দেখলাম, রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি গ্রুপ ভুয়া করোনা রিপোর্ট করে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতড়িয়ে নিয়েছে। জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান পলাতক। হন্ন হয়ে খুঁজছে আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। ধরাছোয়ার বাইরে সে। এমন অনেকেই ধরাছোয়ার বাইরে থেকে উধাও হয়ে যায়। করোনাকালে ইতিপূর্বে জেনেছি একটি বেসরকারি হাসপাতাল ৩০ মিনিট অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮৬ হাজার টাকা আদায় করেছে রোগীর কাছ থেকে। হাজার হাজার টাকা চিকিৎসার নামে আদায় করা হয়েছে এমন অভিযোগ অনেক হাসপাতালের বিরুদ্ধে। আইসিইউ পর্যন্ত পৌঁছানো সাধারন মানুষের কাছে প্রায় দুঃস্বপ্নের মতন। অথচ আইইসিডিআর এর সূত্রমতে ৬৭% শয্যা খালি করোনা চিকিৎসা দেবার কথা এমন হাসপাতালগুলোর। অভিযোগ উঠেছে পিপিই, মাস্ক-গ্লাভস নিয়ে দুর্নীতির। ব্যবহৃত মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস সরবরাহ করা হচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে। বিক্রি হচ্ছে ব্যবহৃত মাস্ক-গ্লাভস, ভেজাল স্যানিটাইজার ফার্মেসীতে। ইতালীতে থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে যাত্রীবাহী বাংলাদেশ বিমান করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হওয়ায়। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন মহাসংকটে। দেশ আর দেশের মানুষের জীবনমরণের প্রশ্নটা এই নিকৃষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছে অর্থলোভের কাছে নিতান্তই গৌণ ।

‘কোথায় থাকো ’ জানার প্রবল তাড়া আমার।

‘হোস্টেল থেকে বের হয়ে একটা মেসে উঠেছিলাম। দুই মাস ভাড়া দিতে পারিনি। মেসমালিক অন্য কোথাও ঘর দেখতে বলায় এখন ---’। কথা শেষ হয় না। গলার ভেতর আড়ষ্টতা তাঁর। চোখ থেকে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। এই বয়সের তরুণের চোখে জল দেখে আমার চোখে বন্যা পরিস্থিতির ছবি ভেসে উঠলো। বাংলাদেশের নদনদীতে এখন জলের উত্তাল ঢেউ। বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে জলের উচ্ছ্বাস। প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। পানিবন্দী লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বাজেট থাকে কোটি কোটি টাকা। বাঁধ সংস্কার হয় না। দেখভাল হয় না। কেবল টাকা চুরি হয়।
‘এখন কোথায় আছো ?’ আমার প্রশ্নের জবাব দিতে তাঁকে সময় নিতে হলো। এপাশ ওপাশ তাঁকিয়ে তারপর ক্ষীণস্বরে বলে, ‘কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রাতে থাকি। ঘর ভাড়া দিতে হয় না। লাইটের আলোও ফ্রী। পড়াশোনা করে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’

‘তোমার কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র ?’ অত্যন্ত পরিশ্রমী দেহ বাকিয়ে বললো, ‘ওসব এখন স্তুপ হয়ে আছে এক বন্ধুর বাসায়।’

প্রতিদিন মানুষের জন্য কাজ করি। প্রতিদিন একবার করে নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে ভালোবাসি। প্রতিদিন একবার করে মানুষ হই। অথচ আজ জন্মগত একজন মানুষ দেখলাম। যে মানুষ হয়ে জন্মে মানুষ হয়েই আছে। আমার ছেলের বয়সের তরুণ। আমার মাতৃত্ববোধ ওকে স্পর্শ করতে চাইলো।

‘তোমার জন্য আমি সামান্য কিছু করতে পারি ?’‘কী সেটা ?’
‘সামান্য আর্থিক সহায়তা।’ দুই হাত জোড় করে মৃদু হেসে উত্তর দিলো, ‘আমার জন্য দোয়া করতে পারেন অনেক যত ইচ্ছে। আমি পরিশ্রম করে টাকা কামাই করতে চাই। আমার বাবা, মা অনেক কষ্টে আমাকে বড় করেছে, স্বপ্ন দেখছে আমাকে নিয়ে। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই !’

প্যাডেলে পা চালিয়ে তারপর সে অদৃশ্য হলো। কতক্ষণ গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। পেছনের একটা সত্য ঘটনা মনে পড়ল।
যে সংস্থায় আমি কর্মরত আছি সেখানে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি শিক্ষাবৃত্তির কার্যক্রম আমাকে দেখতে হয়। প্রায় দশ,বারো বছর আগের ঘটনা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ এক শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করে। সে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চান্স পায় ডাক্তারী পড়ার। মায়ের স্বপ্ন ছেলে ডাক্তার হবে। পুরোনা ঢাকার গিঞ্জি এলাকায় এক রুমের বাসা তাদের। নড়বড়ে কাঠের সিড়ি বেয়ে তাঁদের ঘরে পৌছাতে হয়। ঘরের ভেতর টেবিলের উপর স্তুপাকারে বই। একপাশে খাট। তারপাশে সাজিয়ে রাখা থালাবাসন। চব্বিশ ঘন্টা বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। সূর্যের আলো ঘর পর্যন্ত পৌছায় না। তবে ঘরের ভেতরই যে সূর্য জেগে থাকে চব্বিশ ঘন্টা দিনের পর দিন, বেশ টের পাওয়া যায়।

শিক্ষার্থীর মা অন্যের বাসায় কাজ করেন অর্থাৎ একজন গৃহকর্মী । কাজ করেন সকাল থেকে সন্ধ্যা। বাবার আছে পানসিগারেট এর ছোট্ট একটা দোকান। মেডিকেল পড়া শেষ করা পর্যন্ত শিক্ষার্থী আমাদের সংস্থা থেকে শিক্ষাসহায়তা পেয়েছে। অত্যন্ত সফলতার সাথে সে ডাক্তারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দেখা করতে হাসে। সাথে তাঁর মা। সেইদিন আবিস্কার করলাম, মানুষের হাসি কেবল ঠোঁট নয়, সমস্ত চেহারা ও শরীর জুড়ে থাকে। ছেলে হাসছে। মা হাসছেন। কী অমৃত হাসি। তারপর বেশকিছুদিন পর খবর পেলাম সে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন স্কীনের ডাক্তার। নিয়মিত সে রোগী দেখে। বাবা, মাকে নিয়ে সে এখন বড় বাসায় উঠেছে।

অন্যমনস্কতা কেটে গেলো গন্তব্যে পৌঁছে। টিভির স্ক্রলে সংবাদ প্রচার হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রাণলয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছ থেকে জবাব চেয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্মার্টলি জবাব দিতে প্রস্তুত। ইতিমধ্যে তারা স্মার্টলি বলেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বত্মন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাদের কাছে প্রমাণাদি আছে। আছে ছবি। সেইসব এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যান একজন কার্ডিয়াক সার্জেন। সরকারী হাসপাতালের একজন রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক। করোনার ভুয়া রিপোর্টের জন্য তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাঁর বাবা একজন সাবেক সচিব বলে পত্রিকায় এসেছে। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যান পোশাকআশাকে অত্যাধুনিক ও অভিজাত। দেশ ও সমাজের তথাকথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে তাদের ছবি আছে সঞ্চয়ের থলিতে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই আছেন সেই সঞ্চয়ের থলিতে। শুধু দুর্নীতিবাজ বললে ভুল বলা হবে। বরং বলা উচিত একটা দেশদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আমাদের দেশে। শাহেদ বা সাবরিনার উৎসের মূলউৎপাটন করা না গেলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়বে অতি সন্নিকটে।

করোনাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্টুডেন্ট আজ রিকশাচালিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নিয়েছে, এমন স্টুডেন্টদের খুঁজে সম্মান দেয়া উচিত। তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত সকলের। সংকট কাটিয়ে উঠবার, ঘুরে দাঁড়াবার, বেঁচে থাকবার এরচেয়ে বড় মূলমন্ত্র, উৎসাহ আর কী হতে পারে। অখচ টিভি টকশো কিংবা অন্যকোন অনুষ্ঠানে এঁদের কোন প্রসঙ্গ নেই। আলোচনা নেই। কোন খবর নেই।

জানি না তরুণের সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে কিনা। যদি দেখা হয় তবে ওর বাকিদিনের গল্প শুনবো। ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবো। ওর নাম জানা হয়নি। আপসোস নেই। কারণ সে আমার কাছে মানুষ হিসেবেই দৃশ্যমান হয়েছে, পরিচিতি লাভ করেছে। ভালো থেকো তরুণ মানুষ !

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়