বিনোদন ডেস্ক : অনেকেই ভাবছেন এটা (ফেসবুক পেইজ) আসল না নকল। আসল যারা ভেবেছেন তাদের জন্য শুভকামনা। প্রথম যে পোস্ট দুইটা দেয়া হয়েছে সেটা এন্ড্রু কিশোর- এর কথা। আমি শুধু মাত্র লিখেছি। আমি কিশোরের বউ। এখন আমি কিছু বলবো।

গত বছর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, আমরা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। সেখানে কিশোরের ধরা পরে ডিফিউজ লার্জ বি সেল লিম্ফোমা (ক্যান্সার ইন বউথ এডরেনাল গ্ল্যান্ড। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। ডাক্তার বলেন এখন আর কোন কিছুর দরকার নাই। সবফরপরহব দিয়ে বলেন আগস্ট মাসে আসতে। আমরা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকিট কাটি, কিন্তু কিশোর ভয় পায়, কারণ সে শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিল । আমি টিকিট বাতিল করি। ডাক্তার বলেন, এটা কেমোর জন্য, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে।

পরে ১০ জুন আবার টিকিট কাটি, কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন ডাক্তার। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোন সবফরপরহব তার শরীরে কাজ করছিল না। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন, পেট স্ক্যান করতে হবে, লিম্ফোমা আবার ব্যাক করেছে কিনা দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বর- কে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে , তাহলে সেটা ডাবল স্ট্রং হয়ে আসে আর খুব দ্রুত ছড়ায় এবং সেটা কোনভাবেই কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না। ৯ জুন পেট স্ক্যান হয় এবং সেদিন রাতে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন মানে ১০ জুন সকাল ১০ টায় আমার সাথে পেট স্ক্যান স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান ।

৯ জুন রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি, সকালে ১০ টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে। কিশোর আমাকে বলল, ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরবো। আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি ডক্টর লিম কি বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বলল ডাক্তার ডাকছে । ডক্টর লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বলল লিল্ফোমা ব্যাক করেছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোন কথা বলতে পারছিলাম না, বুঝলাম সব শেষ ।

ডাক্তার বললেন, এন্ড্রুকে কি বলব? আমি বললাম , বলতে তো হবে। ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিন-এর সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। এডরেনাল গ্ল্যান্ড এ কিছু নাই কিন্তু লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তার কে বললাম হোয়াট নেক্সট। ডাক্তার বললেন ও ধস সরি, আমার আর কিছুই করার নাই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

কিশোর বুঝতে পেরেছিল, আমাকে ডাকতে থাকে। ডাক্তার কিশোর কে বলে লিম্ফোমা ব্যাক করেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না, আমি কাল দেশে ফিরব । আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর হাই কমিশন এ ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার প্লেন ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশী ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যামবুলেন্স করে দেশে ফিরে আসি আমরা।

ঈশ্বরের কি খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেভেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন, সে এটা লিখেছিল, ‘ইটস ডিফিকাল্ট টু প্রেডিক্ট বাট টাইপিক্যালি ইন টার্মস অব টার্মস অব মানথস রাদার দ্যান ইয়ার্স।’  এখন কিশোর কোন কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কি ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বর কে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না।

ক্যান্সার ঘি লাস্ট স্টেজ খুব যন্ত্রনাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোর এর জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হল, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ । তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত স্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন আর এন্ড্রু কিশোর এর প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন। বিদায়।