শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ০৩ জুলাই, ২০২০, ০৬:২১ সকাল
আপডেট : ০৩ জুলাই, ২০২০, ০৬:২১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

[১] টাকার অভাবে বই কিনতে না পারা মেয়েটি হলেন এএসপি

ডেস্ক রিপোর্ট : [২] হাওরের মেয়ে ডলি রানী সরকার। অনেক বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন তিনি। জীবনের শুরু থেকে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করে আজ তিনি সফল। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৮তম ব্যাচের পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ডলি রানী সরকার।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানার দক্ষিণ বংশিকুন্ডা গ্রামের কৃষক বাবার সন্তান ডলি রানী সরকার। নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাবার সঙ্গে হাওরের মাঠে কৃষিকাজ করেছেন। বর্ষাকালে পড়াশোনা আর হেমন্তে বাবার সঙ্গে হাওরে ধান কাটা, ফসল লাগানোসহ সব ধরনের কাজে বাবাকে সহযোগিতা করেছেন ডলি। মূলত কৃষিজমি থেকেই শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম।

[৩]
*** কৃষক বাবার সঙ্গে কৃষিজমি থেকেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম
*** নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাবার সঙ্গে হাওরের মাঠে কৃষিকাজ করেছেন
*** শিক্ষকের কিনে দেয়া গাইডবই পড়ে প্রাথমিকে বৃত্তি অর্জন
*** কলেজে ভর্তি হয়ে অর্থের অভাবে ৫-৬টি টিউশনি করেছেন
*** তিন মাস একটানা ১৪-১৫ ঘণ্টা পড়ে বিসিএস ক্যাডার

ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী ছিলেন তিনি। শিক্ষাজীবনের শুরুতে ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানার ঘাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মেধাবী হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখতেন প্রাথমিকে বৃত্তি পাবেন ডলি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় বৃত্তি পাওয়ার সুবিধার জন্য গাইডবই কিনে দিয়েছিলেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুকুল। ওই শিক্ষকের কথা রেখেছেন ডলি, প্রাথমিকে পেয়েছেন বৃত্তি।

[৪] এরপর বংশীকুন্ডা মমিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ডলি। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর তার বাবা অসুস্থ হন। এজন্য পরিবারে দুঃসময় চলে আসে তাদের। এ অবস্থায় সংসার চালানোর ভার পড়ে তার ওপর। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সেবা-যত্ন, জমিতে কৃষিকাজ ও কষ্ট করে সংসার চালানোর সব দায়িত্ব এসে পড়ে ডলির কাঁধে।

হাওর অঞ্চলের সন্তান হওয়ায় বর্ষাকালে পানির সঙ্গে বসবাস। সেজন্য অধিকাংশ সময় বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল না তার। সবকিছু সামলে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় বই কিনতে পারেননি। এ অবস্থায় শিক্ষক ও সহপাঠীদের দেয়া পুরাতন বই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পান ডলি।

[৫] মা-বাবার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবেন, এমনকি ডলিও স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষক হবেন। সেই লক্ষ্য নিয়ে নেত্রকোনার কলমাকান্দা সরকারি কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অর্থের অভাবে টিউশনি শুরু করেন। সেই সঙ্গে লজিং মাস্টার হিসেবে মানুষের বাড়িতে থেকেছেন।

কলেজের প্রথম বর্ষের শেষ দিকে ইভটিজিংয়ের শিকার হন ডলি। শিক্ষকদের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেও বিচার পাননি তিনি। মনে কষ্ট নিয়ে প্রথমবর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর পরিবারের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে চলে যান তিনি। তিন মাস পর দেশে চলে আসেন তারা। দেশে ফিরে কলেজের কোনো পরীক্ষায় অংশ নেননি। পরবর্তীতে শিক্ষকদের উৎসাহে কলেজের টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নেন। সেখানে ভালো ফলাফল করে উত্তীর্ণ হন। ২০০৮ সালে অসুস্থ অবস্থায় এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করেন ডলি।

[৬] নিজের জীবন সংগ্রামের কথা জানিয়ে ডলি রানী সরকার বলেন, আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন দুলাভাই অলক কান্তি সরকার। এত দূর আসার পেছনে দুলাভাইয়ের দেয়া অনুপ্রেরণা ছিল আমার মূল অস্ত্র। এইচএসসি পরীক্ষার সময় দুলাভাই বলেছিলেন তুমি মন দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে যাও। তোমাকে সিলেট নিয়ে যাব। পরীক্ষার পর কথা রেখেছিলেন দুলাভাই। আমাকে সিলেটে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর বলেছিলেন, তোমাকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) চান্স পেতে হবে। তার কথা রেখেছি, শাবিপ্রবিতে চান্স পেয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মেসে উঠি। আর্থিক সঙ্কট থাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি একসঙ্গে ৫-৬টা টিউশনি করেছি। মিলন রায় দাদা টিউশনিগুলো খুঁজে দিয়েছেন। পরবর্তীতে মেস ছেড়ে দেই। এরপর পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিলেটে একটি ভাড়া বাসায় উঠি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়ে অনার্স শেষ করি। ২০১৬ সালে ফিজিক্যাল রসায়নে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে মাস্টার্সে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করি। আমার স্বপ্ন ছিল স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করার। জাপানের মনবুশো স্কলারশিপের জন্য আবেদন করলেও হয়নি’ বলছিলেন ডলি রানী সরকার।

[৭] তিনি বলেন, যেহেতু শিক্ষকতার স্বপ্ন ছিল তাই পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য শিক্ষকতাকে বেছে নিই। তবে এখানে এসেও খারাপ সময় পার করেছি। বাংলাদেশের ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিলেও চাকরি হয়নি। নিরুপায় হয়ে সিলেটের একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। শিক্ষকতার মধ্যেই মাথা চিন্তা আসে বিদেশ যাওয়ার। চেষ্টা করছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার। সেজন্য প্রয়োজন হয় জিআরই পরীক্ষার। জিআরই পরীক্ষার জন্য নিতে শুরু করি প্রস্তুতি। জিআরই পরীক্ষা চলাকালীন বিসিএসের পরীক্ষার ফরম পূরণ করে দেয় এক বান্ধবী। আমি নিজেও জানতাম না বিসিএস দেব। তবে ইচ্ছা ছিল বিসিএস দেয়ার। যার জন্য ছেড়ে দেই শিক্ষকতা। শুরু হয় আবার পড়াশোনা।

ডলি রানী সরকার বলেন, যেহেতু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এবং ইংরেজি ভালো জানি তাই বিসিএস পরীক্ষায় কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। সমস্যা দাঁড়ায় বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক ও গণিতে। পরীক্ষার আগে শুধুমাত্র গণিত ৪-৫ দিন এবং বিজ্ঞান দুইদিন পড়লেও তিন মাস একটানা ১৪-১৫ ঘণ্টা অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়েছি। পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই আনন্দ পেতাম। তাই ১৪-১৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে কোনো কষ্ট হয়নি।

[৮] এএসপি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ডলি রানী বলেন, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশ ক্যাডেট কলেজে চাকরি হয়। ২০১৯ সালে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসাসন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেই। বর্তমানে সেখানে রয়েছি। চার মাস আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রতন কুমার পালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই।

ডলি রানী বলেন, আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি পুলিশ প্রশাসনে। তবে আমি এখনও নিশ্চিত নই; এই পেশায় যাব কি-না। কারণ শিক্ষকতা আমার পছন্দ। তবে দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন আছে আমার। একবার ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছি। আমি চাই না আমার মতো অন্য কেউ এর শিকার হোক। তবে আমি পুলিশে যাই আর না যাই; যেখানেই থাকি ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।

[৯] তিনি আরও বলেন, আমি হাওরের মেয়ে। এখানেই বেড়ে উঠেছি। আমি বুঝি হাওরের মানুষের কষ্ট। আমি চেষ্টা করব হাওরের মানুষের জন্য কিছু করার। আমার সাফল্যে মা-বাবা ও প্রতিবেশীরা খুশি। বাবার একটাই কথা তুমি জীবনে যা করবে সৎপথে থেকে করার চেষ্টা করবে। আমিও বাবার আদেশ মেনে সৎপথে সব কাজ করছি এবং করে যাব। অসৎপথে যাব না, এক পয়সাও অসৎপথে আয় করব না। প্রিয়ডটকম, জাগো নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়