মিনার মনসুর : করোনা সম্ভবত এক অপূরণীয় ক্ষতি করে গেল মানবজাতির। কিছুই আর হৃদয়কে স্পর্শ করছে না। একের পর এক প্রিয়জন চৈত্রের জীর্ণ পাতার মতো ঝরে পড়ছে দেশে-বিদেশে। কয়েকদিন আগেও আমরা ‘আহ’ বলে আর্তনাদ করে উঠতাম, এখন নির্বাক তাকিয়ে থাকি ফেসবুক কিংবা টিভির পর্দায়--যেন এইমাত্র যে ভয়াবহ সংবাদটি শুনলাম তা কিছুতেই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। করোনাপূর্ব পৃথিবীও যে অনভিপ্রেত মৃত্যুর উল্লাসমুক্ত ছিল তা নয়। কিন্তু তখন হৃদয়টা সচল ছিল। উপশমহীন অসহায়তার বজ্রমুষ্ঠি এমনভাবে তার টুটি চেপে ধরেনি। সিন্দবাদের বুড়োর মতো আমাদের অস্তিত্বে চেপে বসেছে অসহায়তার সেই ‘বোধ’। ফলে ‘সব কাজ তুচ্ছ হয়,--পণ্ড মনে হয়,/সব চিন্তা– প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়,/শূন্য মনে হয় !’
আবার অফিসে আসা-যাওয়ার পথে যখন গোলাপ শাহ মাজারের গোলকধাঁধার ভেতরে ঢুকে পড়ি, তখন দেখি অন্য এক পৃথিবী! সেই পৃথিবীতে করোনা বলে কিছু নেই! বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ছে অকুতোভয় জনতার বিপুল কলরব। ভাবি, কেন এই বিপুল বৈপরিত্য? এই মানুষগুলোর কি মৃত্যুভয় নেই? তারা কি সত্যি সত্যিই ‘অবুঝ’? আবার কেউ কেউ যে বলছেন সবটাই কি সেই ‘পেটের দায়’? গর্জমান জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমি আরও বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমার কেন জানি মনে হয়, মনে মনে সবারই একটা নিজস্ব হিসাব আছে। সেই হিসাবটি হলো, পৃথিবীর প্রায় সাড়ে সাতশতাধিক কোটি মানুষের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যদি ১০ কোটি মানুষও মারা যায়, তার পরও তো সাতশ কোটি মানুষ বেঁচে থাকবে! অতএব, এত ভয়ের কী আছে!
অঙ্কটি সরল। যদি এই সূত্রটা আমরা গ্রহণ করি তাহলে ফিরে যেতে হবে সেই পুরনো হিসাবে। সড়ক দুর্ঘটনায়, যুদ্ধে-সন্ত্রাসে কিংবা ভেজাল খেয়ে যত লোকই মরুক তাতে আমার কী! (আমি তো আর মরছি না বা মরিনি!) বাস্তবতা হলো, যার যায় সে-ই কেবল জানে। ইলিয়াস কাঞ্চন জানেন, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত বেদনার গভীরতা কেমন। মিডিয়াগুলো করোনাবিধ্বস্ত ভুক্তভোগীদের বুকভাঙা আর্তনাদকে আর একটু তীব্রভাবে তুলে ধরতে পারলে হয়ত পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতো।
অনেকদিন পর বাসার ছাদে প্রথমে বুলবুলিটিকে, পরে চিলটিকে দেখলাম। দুজনই একা। এপ্রিলের শুরুতে যখন প্রথম দেখেছিলাম পাখিদুটিকে, তখন তাদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি তাতে এখন ভাটার টান। দুজনের শরীরী ভাষার মধ্যেই কেমন যেন বিষণ্নতা লেপ্টে আছে। তবে কি প্রকৃতিও কিছুটা হাঁফিয়ে উঠেছে? রূপবন্দনা করার মতো প্রেমিকহৃদয় যদি না থাকে, তাহলে এত এত রূপমাধুর্য দিয়ে হবেটা কী!
আপনার মতামত লিখুন :