শামিউল হক, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : [২] ধানের নাম ‘আব্দুল গুটি’। এর বীজের উদ্ভাবন কোথায় কারোই জানা নেই। তিন বছর আগে এটি চলনবিলের কৃষকের বীজ ভান্ডারে স্থান করে নেয়। তিন মৌসুমে (বোরো, আউশ ও আমন) পরীক্ষামূলক চাষ করে ফলাফল এসেছে বাম্পার। কৃষকেরা জানিয়েছেন এ যাবতকালে ব্রি উদ্ভাবিত চিকন ধানের বিভিন্ন জাত, ভারতীয় জাত ও স্থানীয় পর্যায়ের সকল জাত কে টেক্কা দিয়ে পিছনে ফেলেছে ‘আব্দুলগুটি’। ফলনে বাম্পার হওয়ার পাশাপাশি স্বাদেগন্ধে এমনকি দামেও সে রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত জাত ব্রিধান-৩৬ আব্দুল গুটির কাছাকাছি পর্যায়ের। তবুও চলনবিল অঞ্চলের কৃষক ব্রি-৩৬ কে গ্রহণ করছেন না। চলনবিলের অনেক জায়গায় এখন আব্দুলগুটির জয়জয়কার।
[৩] আব্দুলগুটির নাম করণ:
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার পালাশী গ্রামের আব্দুল নামের জনৈক কৃষক নাটোর জেলার কালিগঞ্জ এলাকা থেকে তিন বছর আগে স্থানীয় জাত “গুটি ধান” হিসেবে এ ধানের বীজ সংগ্রহ করেন। কিন্তু ধানটি গুটি জাতের না হয়ে হয় ভিন্ন জাতের। তিনি এটি রোপা আমন মৌসুমে পরীক্ষামূলক চাষ করে বাম্পার ফলন পান। ওই মৌসুমে অন্যান্য কৃষক আবাদ করেছিলেন কাঁটারিভোগ ও ব্রিধান-৩৬ ধানের। তাদের ধান পানিতে ডুবে এবং ঝড়ো বাতাসে হেলে পড়ে বিনষ্ট হয়। কিন্তু আব্দুলের ধান হেলে না পড়ে বাম্পার ফলন দেয়। গ্রামের লোকজন তার থেকে বীজ সংগ্রহ করেন। চিকনজাতের এ ধান স্বাদেগন্ধে আকর্ষনীয় হওয়ায় বিক্রি হয় প্রতি মন ধান দু’হাজার টাকা দরে। বীজধান বিক্রি করেন চার হাজার টাকা দরে। এতে তার গুটি লাল (স্থানীয় ভাষায়) অর্থাৎ ভাগ্য খুলে যায়। সেই থেকে এ ধানের নাম হয় ‘আব্দুলগুটি’। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, এটি ব্রি কোন ভ্যারাইটি না হওয়ায় জাতটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা হচ্ছে।
[৪] জাতটির বৈশিষ্ট্য:
জাতটির জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন, গাছের উচ্চতা ৮৫ -৯০ সেন্টিমিটার, চারা ঠান্ডা অব্স্থায় সহনশীল, পাকার সময় পর্যন্ত গাছ কিছুটা সবুজ থাকে, ঝড়ো বাতাসেও গাছ হেলে পড়ে না এবং বোঁটা শক্ত হওয়ায় ধানও ঝোরে পড়েনা, শীষের আকৃতি বড় এবং প্রতিটি শীষে দানা থাকে ২৫০ থেকে ২৮০ পর্যন্ত। চাল খাটো ও চিকন, ভাত ঝরঝরে, সুগন্ধযুক্ত এবং খেতেও সুস্বাদু। সাধারণত: উঁচু-নীচু সবধরনের জমিতেই চাষ হয়। তিনটি মৌসুমে এটি আবাদ করা যায়।
[৫] মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ:
সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যূষিত তাড়াশ উপজেলাতে এ বছর ২২ হাজার ছয় শ ৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। চাষিরা এ বছর হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাত সহ প্রায় ৩০টি জাতের ধান রোপণ করেছেন। এরমধ্যে ৩০৬০ হেক্টর জমিতে আব্দুলগুটি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে।
[৬] তালম গ্রামে কৃষক মো: হোসেন আলী বলেন, তিন মৌসুমে আবাদ করে দেখা গেছে আব্দুলগুটির ফলন বাম্পার। বোরো মৌসুমে ২২-২৫ মন, আউশ মৌসুমে ১৪-১৬ মন এবং রোপা আমন মৌসুমে ১৮-২০ মন ধান প্রতি বিঘায় উৎপাদন হয়ে থাকে (৩৩ শতকে এক বিঘা)।
[৭] পালাশী গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মো: আব্দুল হান্নান বলেন, তিনি এ বছর চলতি বোরো মৌসুমে আব্দুলগুটির চাষ করে প্রতিবিঘায় ২৪-২৬ মন পর্যন্ত ধান পেয়েছেন। দামও চড়া। যেখানে মিনিকেট সহ অন্যান্য চিকন ধান নয শ থেকে সাড়ে নয় শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে , সেখানে আব্দুলগুটি সাড়ে ১১ শ থেকে ১২ শ টাকা দরে বিক্রি চলছে। উপজেলার কৃষকদের মাঝে এ ধানের বীজ সংগ্রহের প্রবল আগ্রহ দেখা গেছে। এ বছর তিনি এক শ মন বীজ ধান বিক্রি করেছেন পাঁচ হাজার টাকা মন দরে।
[৮] আব্দুলগুটি নিয়ে কৃষকের ভাবনা:
তাড়াশ উপজেলার ভাদাস গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিল। তিনি এ মৌসুমে ৩০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ২০ বিঘা আব্দুলগুটি। ফলন ও দাম উভয়েই বেশি হওয়ায় এ ধান নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন।
তিনি বলেন, অন্যান্য জাতের ধানের চাষ করে গত তিন বছর যাবত লোকসান গুণছেন। কিন্তু আব্দুলগুটি তাকে আশা জাগিয়েছে। এ ধরণের ফলন ও দাম পেলে কৃষকের ভাগ্য বদলাতে সময় লাগবে না। তবে এর পাশাপাশি শঙ্কার কথাও জানালেন তিনি। তার আবাদকৃত কাঁটারিভোগ ধানে নেকব্লাস্টের সংক্রমণ দেখা গেছে। সেখান থেকে আব্দুলগুটিও কোথাও কোথাও সংক্রমিত হচ্ছে। এ কারণে ভবিষ্যতে কি হয় সেটি দেখার জন্য কৃষককে অপেক্ষা করতে হবে।
[৯] ব্রিধান-৩৬ না আব্দুলগুটি ?
চলনবিল অঞ্চলের যে কোনো ধানেরহাটে গিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা কে প্রশ্ন করে আপনি বিভ্রান্ত হতে পারেন ধানটি ব্রিধান-৩৬ না আব্দুলগুটি? কেউ বলছেন ব্রিধান-৩৬, কেউ বলছেন আব্দুলগুটি, আবার কেউ কেউ বলছেন যা ৩৬ তাই আব্দুলগুটি। কেনাবেচাও হচ্ছে উভয় নামে।
তাড়াশ উপজেলা কৃষি অফিসারের কার্যালয় বোরো ধানের জাতভিত্তিক কর্তনের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাতে তারা উল্লেখ করা হয়েছে, “ব্রিধান-৩৬ (সুগন্ধি আব্দুলগুটি)”।
[১০] তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লূৎফুন নাহার লূনা বলেন, জাতটি উভয় নামে পরিচিত হওয়ায় আমরা এভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছি।
কিন্তু চলনবিল এলাকায় বীজ উৎপাদনের সাথে জড়িত ভাঙ্গুড়া উপজেলার খান মরিচ গ্রামের এস.এম মনিরুজ্জামান কৃষি অফিসারের এ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, আব্দুলগুটি ও ব্রিধান-৩৬ সম্পূর্ণ ভিন্ন জাত। আব্দুলগুটির ধান চিকন ও খাটো এবং ব্রিধান-৩৬ চিকন ও লম্বা। ফলনেও বেশ তারতম্য রয়েছে।
[১১] কৃষিবিভাগের বক্তব্য:
চলনবিল অঞ্চলের কৃষক আব্দুলগুটি নিয়ে আশাবাদী হলেও সন্তুষ্ট হতে পারছেনা কৃষি বিভাগ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: মোফাজ্জল হোসেন বলেন, এক বীজ থেকে বারবার বীজ করলে ফলন কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আব্দুলগুটির ক্ষেত্রেও একই ফলাফল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
[১২] কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক মো: হাবিবুল হক বলেন, কৃষক মূলত: সাময়িক লাভ দেখেই যে কোন জাতের প্রতি ঝুঁকে পরেন। উল্লেখিত এসব জাতের ধানও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত: ধানগুলো চিকন,আঠালো, দামে বেশি এবং ফলন আশানুরুপ হওয়ায় কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তবে ব্রি উদ্ভাবিত বীজ নিয়ে প্রচারণা, সময়মতো সরবরাহ এবং মাঠ পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ থাকার উপর জোর দেন এই কর্মকর্তা।
[১৩] তিনি বলেন, সরকার যখন কোন বীজ আমদানী করে তখন তা কোয়ারেন্টিনে রেখে পর্যবেক্ষণ করে, তবেই মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চোরাইপথে আসা বীজের ক্ষেত্রে তেমনটি না হওয়ায় রোগবালাইয়ে সংক্রমিত হওয়ার ভয় রয়েছে। আব্দুলগুটি নামক জাতটি আমরা পর্যক্ষেণ করে দেখছি। সম্পাদনা : হ্যাপি
আপনার মতামত লিখুন :