সোহেল অমিতাভ : মুজিব হত্যাকারীর মুখোমুখি। সময় : ১৯৮৫ কোনো এক সন্ধ্যা। স্থান-বাগদাদ, কাউন্সিলরের বাসভবন, বাংলাদেশ দূতাবাস। হোস্ট-১৫ আগস্ট হত্যাকা-ে অংশ নেয়া কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশার (হত্যাকা-ের সময় মেজর এবং মেজর বজলুল হুদার ভগ্নিপতি) গেস্ট- বিখ্যাত ব্যবসায়ী লন্ডন থেকে আগত জহুরুল ইসলাম। বিশিষ্ট প্রবাসী বাংলাদেশি, দূতাবাসের অন্যান্য ডিপ্লোম্যাটস ও মুজিববাদ লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। উপলক্ষ্য ইতালির দূতাবাস থেকে বাগদাদে কাউন্সিলর হিসেবে পাশার নতুন পোস্টিং এবং প্রথম গণসংযোগ রিসেপশন পার্টি। নোট- রিসেপশন পার্টি কিছুটা গুরুগম্ভীর। রাষ্ট্রদূত আসেনি। অনুষ্ঠান জহরুল ইসলামকে কেন্দ্র করে জমে উঠছে। মনে হলো নতুন কাউন্সিলর ও তার স্ত্রী ইসলাম সাহেবের পূর্ব পরিচিত, সেটা হয়তো তাদের ইউরোপে পোস্টিংয়ের কারণে হতে পারে।
আমি আর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এক কোণে সোফায় বসে চুপচাপ ব্ল্যাক লেবেল গিলছি আর নতুন কাউন্সিলরের গতিবিধি সহ ইসলাম সাহেবের সঙ্গে কথোপকথন লক্ষ্য করছি নিরবে। জহুরুল ইসলাম বাইরের খাবার খান না জানিয়ে ফিরে গেলেন লেবার ক্যাম্পে। সেখানে তার নিজস্ব কুক রান্না করে বসে আছে। লন্ডন থেকে বাবুর্চি তার সঙ্গেই এসেছে। এটা ইসলাম সাহেবের স্বাস্থ্যবিধি। অগত্যা তাকে না খাইয়েই বিদায় দিলেন কাউন্সিলর দম্পতি। ডাইনিং টেবিলে তখন খাদ্য ভিড়। আমরা তখনও সেই কোণে বসে একই কর্মে। মুজিব হত্যাকারী এবার মুজিববাদ লেখকের উদ্দেশ্যে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বিনয়ের সঙ্গে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের মত একজন পন্ডিত ব্যক্তির পদধূলি পড়েছে তার গৃহে এজন্য। ইলিয়াসও কম ডিপ্লোম্যাট নন। যথাযথ প্রটোকলের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন সম্মানিত কূটনীতিকের আমন্ত্রণ রক্ষা করা তার নৈতিক দায়িত্ব। আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি আনন্দিত। নতুন দায়িত্বে কাউন্সিলর যেন সফলভাবে তার কার্যকাল পালন করতে পারেন সেই কামনা করলেন।
হঠাৎ আমাকে উদ্দেশ্য করে পাশা জিজ্ঞাসা করলেন : আচ্ছা সোহেল সাহেব আপনাদের তরুণদের ১৫ আগস্ট ৭৫ সম্পর্কে কী ধারণা? আমি এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ১০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তখনো এসম্পর্কে মাত্র দুটো লাইন লিখেছি, তাও কবি নির্মলেন্দু গুণকে সাধুবাদ জানিয়ে। সাহিত্যাঙ্গনকে কটাক্ষ করে। রাজনীতির বিষয় ছেড়ে দিয়েছি রাজনীতিকদের হাতে। তবুও দ্রুত মুখ থেকে অত্যন্ত ঘৃণা ও ক্লেদাক্তভাবে উত্তর বেরিয়ে এলো। বললাম, রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, এই আর কী। কর্ণেল পাশার রগে টান পড়লো, ডিপ্লোম্যাটিক খোলস থেকে তার উর্দি মেজাজ বেরিয়ে এলো। উচ্চস্বরে আমাকে লক্ষ্য করে ধমকের সুরে বললেন, ঘোড়ার আন্ডা জানেন, কিছুই জানেন না আপনি। এবার তিনি হত্যাকারীদের একে একে নাম উচ্চারণ করে তারা যে মহান মুক্তিযোদ্ধা সেই তালিকা প্রকাশ করলেন আর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে লাগলেন। ইলিয়াস অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে পরিস্থিতিটাকে ট্যাগেল দিচ্ছেন। আমি পাশাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে শেখ মুজিবকে হত্যা করলেন কেন আপনারা?
ছিমছাম গম্ভীর পার্টিতে ছন্দপতন হলো। অনেকেই তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিচ্ছেন।
পাশার স্ত্রী এসে পাশাকে ঠা-া হতে অনুরোধ করে গেলেন এবং অতিথিদের বিদায় দিয়ে আমাদের কোণায় এসে অংশগ্রহণ করে ডিনার খেতে অনুরোধ করলেন। পাশাও সুর কিছুটা নরম করে বোঝালেন, হত্যা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশ তারা একটা জরিপ করে দেখেছিলো। জরিপের ফলাফল বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না তখন। তাইতো তার হত্যার পর কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ দৃষ্টিগোচর হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইলিয়াসকে ডিনার করতেই হলো। কাউন্সিলর দম্পতি খুব আদর যতœ করে তাকে আপ্যায়ন করলেন। এবার আমি ডিপ্লোমেটিক হয়ে গেলাম বললাম, আমি অনেক লেট করে ডিনার করি, ইলিয়াস সাহেবকে বাসায় পৌঁছে আমাকে নাইট ক্লাবে যেতে হবে আমার বিজনেস মিটিং আছে। ইলিয়াস সাহেবকে দূতাবাসের গাড়িতে বাসায় পৌঁছে দেবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলো ধন্যবাদের সঙ্গে।
আমরা বেরিয়ে আসার সময় পাশার স্ত্রী তার স্বামীর অস্বাভাবিকতার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললেন ওর মেজাজ একটু চড়া, কিছু মনে করবেন না আপনারা। বেরিয়ে এসে ইলিয়াস আমাকে বললেন, তুমি কখন কি বলতে হবে সেটার চর্চা করো। মানুষকে মুখের উপর সত্য কথাটা বলতে নেই। সত্যিই তো মুজিববর্ষে নতুন চাটার দল পরিবেষ্টিত শত সহস্র মুজিব কোটের ভিড় দেখে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, এতদিন কোথায় ছিলেন ? অথচ এই সত্য কথাটি এখন বলা যাবে না। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :