শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও

প্রকাশিত : ০৬ জুন, ২০২০, ১০:২৪ দুপুর
আপডেট : ০৬ জুন, ২০২০, ১০:২৪ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. শোয়েব সাঈদ : কোভিডে প্লাজমা থেরাপি

কোভিড যুদ্ধে প্লাজমা থেরাপি সম্প্রতি আশার আলো দেখাচ্ছে রোগীকে গুরুতর অবস্থা থেকে রক্ষা করতে, সুস্থ করতে। কোভিড যুদ্ধে বিজয়ীজন আক্রান্ত অন্যকে এই যুদ্ধ জয়ে সহায়তা করতে পারেন তাঁর রক্তের জলীয় অংশ প্লাজমা দিয়ে। কানেডিয়ান গাইডলাইন অনুসারে বয়স ৬৭ এর উপর নয়, ল্যাবরেটরী টেস্টে কোভিড পজিটিভ ছিলেন, পরে সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসমুক্ত বা নেগেটিভ হয়ে অন্তত ২৮ দিন কোভিড উপসর্গ মুক্ত ছিলেন এবং একজন স্বাভাবিক রক্তদাতার মত রক্ত সংক্রামক রোগমুক্ত হবার শর্তপূরণে সক্ষম ব্যাক্তিই কেবল কোভিড -১৯ রোগে প্লাজমা দেবার যোগ্যতা রাখেন। নেগেটিভ কিনা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করার জন্যে একাধিক টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকেই। ইউএসএফডিএ এর গাইডলাইন কানাডার মত তবে তাঁদের মতে নেগেটিভের পর উপসর্গ মুক্ত থাকার সময় ১৪ দিন।

প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয় তাঁদের যারা অন্য কোন প্রকার ট্রিটমেন্ট থেকে উপকৃত নন। ড্রাগে কাজ হচ্ছেনা, খুব অসুস্থ যারা তাঁদের এআরডিএস এর মত মারাত্মক অবস্থায় ফুসফুস অচল হয়ে জীবন সংহারী অবস্থা তৈরি হয় এবং ভেন্টিলেটরে সাহায্য শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া অসুখ-বিসুখে ভুগছেন যারা, তাঁদের কোভিড হলে গুরুতর অবস্থা থেকে সুরক্ষা দেবার জন্যে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়। আত্মীয় স্বজন আর রক্তের গ্রুপে মিল আছে এমন কোভিড আক্রান্তদের কাছ থেকে প্লাজমা নেওয়া উত্তম। প্লাজমা থেরাপি নিরাপদ। এইচআইভি কিংবা হেপাটাইটিস ভাইরাসে দূষিত রক্তের ঝুঁকি স্ক্রিনিং স্টেপেই দূর করা হয়। ইউএসএফডিএ সহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে চলে কোয়ালিটি প্লাজমা সংগ্রহে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়।

প্লাজমা থেরাপি নতুন কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়। শত বর্ষের পুরাতন এই থেরাপিউটিক ব্যবস্থাটি ১৯১৮ সালের স্পেনিশ ফ্লু, ১৯২০ সালের ডিপথেরিয়া, ২০০৩ সালের সার্স মহামারি, ২০১৫ সালের আফ্রিকায় এবোলা আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। চীনে কোভিড মহামারির শুরু দিকে গুরুতর কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞান চলে প্রমাণ আর সেফটি সুরক্ষার পদ্ধতিগত নিয়ম মেনে, মিডিয়া কেন্দ্রিক প্রচারণার জোরে নয়। প্লাজমা থেরাপির নিরাপদ ব্যবহারে ইতিহাস থাকার পরও, কোভিড সংকটের নির্দিষ্ট ভাইরাস SARS-CoV-2 এর ক্ষেত্রে এই থেরাপি ব্যবহারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা আর পিয়ার রিভিউ বা তৃতীয় পক্ষ দ্বারা মূল্যায়ন অবশ্যকরণীয়। গত ২৬ শে মে আমেরিকান জার্নাল অব প্যাথলজিতে কোভিড যুদ্ধে প্লাজমা থেরাপির ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পিয়ার রিভিউড এবং প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় ২৫ জন কোভিড রোগীর ১৯ জনই প্লাজমা থেরাপিতে ভাল হয়ে যায়। হিউস্টন মেথোডিস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এরিক সেলাজারের নেতৃত্বে এই স্টাডি কোন প্রকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়া নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। নিরাপদ ড্রাগ আর ভ্যাক্সিনের আপাতত অভাবে করোনা সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাওয়া বিশ্বের কাছে মরনাপন্নদের বাঁচাতে এটি একটি চমৎকার কৌশল। ইউএসএফডিএ ইমারজেন্সি ইউস গাইডলাইনে ট্রায়াল শুরু করে পরবর্তীতে এফডিএ এর অনুমোদন পেয়ে এপ্রিলে বড় অবয়বে ট্রায়াল শুরু করা হয়। ট্রায়াল শেষে প্রটোকল আর ফলাফল কোয়ালিফাইড বিশেষজ্ঞদের দ্বারা মূল্যায়ন শেষে পাব্লিকেশনের মাধ্যমে সফলতার প্রমান পেল বিশ্ব। এর আগে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনে চীনাদের গবেষণা প্রবন্ধে কোভিড চিকিৎসায় উপকারিতার কথা প্রথম প্রকাশিত হয়। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরও প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে প্লাজমা থেরাপির জন্যে এফডিএ অনুমোদন পেয়েছে।

গত এপ্রিলে কানাডায় শুরু হয় প্লাজমা থেরাপির বিশ্বের বৃহত্তম ট্রায়াল। কানাডার ৫০টির বেশী ইন্সটিটউশনের সমন্বয়ে শুরু এই ট্রায়ালে মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সহ অসংখ্য বিজ্ঞানী, ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীর সহযোগিতায় হাজারের বেশী রোগীর উপর পরিচালিত হচ্ছে। ফলাফল শীঘ্রই আশা করা হচ্ছে। প্লাজমা থেরাপি মূলত একজনের কাছ থেকে আরেকজনের ইমিউনিটি ধার করা। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ কোভিড সংক্রমণে সুস্থ হয়ে প্লাজমা থেরাপির ডোনারের যোগ্যতা হয়তো অর্জন করেছে। কিন্তু এই যোগ্যতার মাত্রা আর স্থায়িত্ব নিয়ে অনেক কিছু জানার বাকী গবেষকদের। সতর্কতার সাথে ক্লিনিক্যাল আর ল্যাবরেটরি মূল্যায়নের পর SARS-CoV-2 এর জন্যে নির্দিষ্ট IgG এন্টিবডি সমৃদ্ধ প্লাজমা গ্রহিতাকে প্রদানের সিদ্ধান্ত দেন বিশেষজ্ঞ কর্তৃপক্ষ। এই প্লাজমার IgG এন্টিবডি গ্রহীতার ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করে ভাইরাল লোড কমিয়ে আনে।

ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের মত বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করতে আমাদের শরীর নিজে থেকেই কিছু সৈন্য তৈরি করে। “টিট ফর টেটের” মতই চিহ্নিত শত্রুরকে ধ্বংস করতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই সৈন্যদের বলা হয় এন্টিবডি। এন্টিবডিগুলো মূলত প্রোটিন এবং এই প্রোটিনের জন্ম হচ্ছে প্রয়োজনে অর্থাৎ নির্দিষ্ট এন্টিজেনের উপস্থিতিতে শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সহজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে। প্রতিরক্ষামূলক আক্রমণে প্রথমে হাল্কা থেকে মাঝারী পরে তীব্র আক্রমণের জন্যে সৈন্য বিন্যাসের বিশেষ কৌশল থাকে। ভাইরাসের মত বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলায় প্রথমে একশনে যায় যে সৈন্যদল তারা ইম্যুনোগ্লোবিন M (IgM) নামক এন্টিবডি গোত্রের, যা ভাইরাসকে আটকে ফেলবার বা গ্রেফতারের চেষ্টা করে। সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে এই চেষ্টার পর সপ্তাহ খানেক গেলে আরো শক্তিশালী সৈন্যদল যারা ইম্যুনোগ্লোবিন G (IgG) নামক এন্টিবডি গোত্রের, তারা সাঁড়াশি আক্রমণ অর্থাৎ শত্রুকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলবার মাধ্যমে খতম করার চেষ্টা করে। চেষ্টা সফল হলে রোগী ভাল হয়ে যায় এবং এই সব সৈনিক বা এন্টিবডির উপস্থিতি থেকে যায় রক্তে। রক্তে এন্টিবডির স্থায়িত্ব বিভিন্ন রোগে বিভিন্ন রকম অর্থাৎ স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদী। এই এন্টিবডির উপস্থিতি থেকে জানা যায় সংক্রমণের ইতিহাস। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এই IgG এন্টিবডি থেকে ইম্যুনিটি প্রাপ্তির জন্যেই প্লাজমা থেরাপির আয়োজন। আমাদের সময়ে “কোভিড টেস্টের কুহেলিকা” শীর্ষক লেখায় এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি।

এতক্ষণের আলোচনায় ছিল প্লাজমা থেরাপি, এখন আসি প্লাজমা প্রসঙ্গে। রক্ত বিষয়ে আমাদের সবারই কমবেশি ধারণা আছে। রক্ত সংগ্রহ করার পর রক্তকে জমাট বাঁধতে দিয়ে বা জমাট বাঁধতে না দিয়ে সেন্ট্রিফিউজ করে রক্ত কনিকাগুলো আলাদা করার পর যে তরল অংশ টেস্ট টিউবের উপরে দিকে থাকে যথাক্রমে তাদের সেরাম আর প্লাজমা বলে। জমাট বাঁধতে না দেওয়া রক্তের আলাদা করা হলুদ তরল অংশ প্লাজমা হচ্ছে মূলত রক্তের ৫৫% অংশ। প্লাজমায় থাকে পানি, লবণ, এনজাইমস, প্রোটিন (এন্টিবডি, এল্বুমিন ইত্যাদি), ক্লটিং উপাদান ইত্যাদি। আমেরিকান রেডক্রসের মতে একজন সুস্থ মানুষ ২৮ দিন পরপর অর্থাৎ বছরে ১৩ বার প্লাজমা দিতে পারে। যাঁদের রক্তের গ্রুপ A উনারা প্লাজমা নিবেন A, AB গ্রুপ ওয়ালাদের কাছ থেকে, B গ্রুপের মানুষ B, AB গ্রুপ থেকে, AB ওয়ালারা AB থেকে আর O ওয়ালারা অবারিত, নিতে পারেন যে কোন গ্রুপ থেকে।

শুরুতেই বলেছি প্লাজমা থেরাপি কোভিড যুদ্ধে আশা নিরাশার দোলাচলে গুরুতর রোগীদের জন্যে আশার আলো। এই ক্ষেত্রে “নিরাপদ” প্লাজমা পূর্বশর্ত। বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি চলছে। টেস্টের সংখ্যা কম হওয়ায় চিহ্নিত দাতার সংখ্যা সংক্রমণের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চলে আসা দীর্ঘ দিনের কিছু অবাঞ্চিত, অনৈতিক কৌশলের কারণে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে “নিরাপদ” নামক জীবন-মৃত্যুর পার্থক্যকারী অধিকারটি। প্লাজমার মান এবং সেফটি গুরুতরভাবে কম্প্রোমাইজ হবার বেশ কিছু ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে নজরে এসেছে। প্লাজমা থেরাপির প্রটোকলে দেশ অনুযায়ী কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মৌলিক বিষয়ে প্রটোকলে পার্থক্য নেই। প্লাজমাটি SARS-CoV-2 সহ HIV কিংবা হেপাটাইটিস ভাইরাস মুক্ত থাকা প্রধান আর প্রাথমিক শর্ত। কোভিড আক্রান্ত হয়ে নেগেটিভ হবার পর উপসর্গবিহীন সময়ের ন্যুনতম মানটি রক্ষা করা বাধ্যতামূলক। গুরুতর কোভিড রোগীদের বাঁচাতে ডেসপারেট স্বজনরা হাতের কাছে যা পান আঁকড়ে ধরবেন এটাই স্বাভাবিক। প্লাজমা প্রটোকল অনুসারে ঠিকমত সংগ্রহ না হয়ে থাকলে হিতে বিপরীত হবার বড় ঝুঁকি রয়ে যায়। রক্ত বেচাকেনার মত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অপরিচিতদের কাছে প্লাজমা সন্ধানে যাওয়া যাবে না। রক্তের চাইতে কোভিড প্লাজমা সংগ্রহের বিষয়টি অনেক টেকনিক্যাল, পরীক্ষা আর রেগুলেশন নির্ভর। প্লাজমা থেরাপিতে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের বৈশ্বিক মানদণ্ডে কঠোর অবস্থানে থাকা নিরাপদ আর কার্যকরী প্লাজমা নিশ্চিতকরণের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারী জরুরী।

লেখকঃ কলামিস্ট এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক বিষয়ে মন্ট্রিয়লে বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়