শিরোনাম
◈ ব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ◈ অবশেষে মার্কিন সিনেটে সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস ◈ কক্সবাজারে ঈদ স্পেশাল ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল চলাচল বন্ধ ◈ ইউক্রেনকে এবার ব্রিটেননের ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ◈ থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ◈ লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, চাপ পড়ছে গ্রামে ◈ এফডিসিতে মারামারির ঘটনায় ডিপজল-মিশার দুঃখ প্রকাশ ◈ প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ◈ প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাত চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন নির্বাচিত ◈ বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিত : ১০ মে, ২০২০, ০২:৩৪ রাত
আপডেট : ১০ মে, ২০২০, ০২:৩৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম সভা ও পরের কিছু ঘটনা

এম. নজরুল ইসলাম : বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে। আর এর পর থেকেই দেশজুড়ে এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। স্তম্ভিত জাতি তখন দিকনির্দেশনাহীন। সামরিকতন্ত্রের বুটে পিষ্ট গণতন্ত্র। সুযোগ বুঝে দলের স্বার্থণে¦ষী গোষ্ঠী তখন ঘাতকদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। বাকস্বাধীনতা ছিল না দেশে। নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। দেশের বাইরেও কেউ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেননি। বাঙালিদের কাছে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকান্ড এমন এক অবিশ্বাস্য ও নারকীয় ঘটনা ছিল যে, শোকে মুহ্যমান জাতি একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার মতো শক্তি সেই মুহূর্তে ছিল না। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ করে হারিয়ে গোটা জাতি এমন শোকাহত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল যে, কোনোরূপে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের শক্তিও তাদের ছিল না। কিন্তু থেমে ছিলেন না জাতির জনকের দুই কন্যা। তাঁরা বিশ্বমানবতার কাছে পিতৃহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। বিচার চেয়েছিলেন ইতিহাসের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বিশ্বমানবতার কাছে প্রথম আবেদন রাখা হয় ১৯৭৯ সালের ১০ মে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিশ্বমানবতার কাছে এই আর্জি পেশ করেছিলেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।

দিনটি ছিল ১০ মে ১৯৭৯। সেদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলন। ঐ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্ব ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন, সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর পাঠানো বাণী পাঠ করেন শেখ রেহানা। তাঁর পক্ষে বক্তব্য রাখেন তিনি। এটাই ছিল কোন রাজনৈতিক সমাবেশে শেখ রেহানার প্রথম বক্তব্য রাখা। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলংকজনক ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলেন। সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, আমেরিকার কংগ্রেস এর হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পৈশাচিক বর্ণনা দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানার আবেগঘন বক্তব্য সে অনুষ্ঠানে এক হƒদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। হলভর্তি প্রবাসী বাঙালি নারী-পুরুষ এবং বিদেশী রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্ট সদস্য ও সাংবাদিক পিনপতন নীরবতায় তাঁর বক্তব্য শোনেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনায় অনেকের চোখই অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ট্রাজেডির বিচার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সবসময় ভাবতেন। ১৯৭৯ সালে এ ব্যাপারে তিনি টেলিফোনে দিল্লিতে বড় বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ড. শফিক সিদ্দিক সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম। যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকন্যাদের সম্মতিতেই ড. শফিক সিদ্দিক আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন এই ব্রিটিশ আইনজীবীর নাম প্রস্তাব করেছিল।
স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও ড. শফিক। এবং তাঁকে জানান, বিদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি পদের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়েছে। তিনি এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন।

১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডন যান। শেখ রেহানা তখন সন্তানসম্ভবা। ১৯৮০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক দিন স্যার টমাস উইলিয়ামস শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। স্যার টমাস উইলিয়ামস ঐদিন তাঁকে পার্লামেন্ট বিল্ডিং ঘুরিয়ে দেখান। ঐ সময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে তাঁকে অনুরোধ করেন। এতে তিনি সম্মত হন। কিছু দিন পর আবার স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন।

শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম শাহাদাত বার্ষিকী পালন উপলক্ষে ১৬ আগস্ট ১৯৮০ পূর্ব লন্ডনের মাইল্যান্ড ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের পর প্রবাসী বাঙালিদের এর চেয়ে বড় সমাবেশ আর অনুষ্ঠিত হয়নি। সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি প্রধান বক্তা ছিলেন। তাছাড়া ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে ড. কর্নরার্ড উড এবং লেবার পার্টির দু‘জন পার্লামেন্ট সদস্য বক্তব্য রাখেন। সেদিন বেশ কজন ব্রিটিশ রাজনীতিক ও প্রখ্যাত আইনজীবী এবং বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালির উপস্থিতিতে শেখ হাসিনার অনুরোধে স্যার টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করার ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন বলে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দেন।

বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞদের নিয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ‘হাউস অব কমন্স’-এর নিকটবর্তী কুন্দুন রেষ্টুরেন্টে এক সাংবাদিক সম্মেলন এর মাধ্যমে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউ সি এম পি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন, স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউ সি এমপি, সদস্যরা হলেন, নেবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র জেফ্রি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার অব্রে রোজ। অব্রে রোজকে কমিশনের সেক্রেটারীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে তদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও কনজারভেটিভ পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র ও এমপি, লিবারেল পার্টির আইন বিষয়ক মুখপাত্র ও এমপিসহ বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাসহ বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে এই তদন্ত কমিশন গঠন ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর চেষ্টার ফসল।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফ্রি টমাস কিউ সি এম পি এবং সলিসিটার অব্রে রোজ বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন পেশ করেন। তাঁদের ভিসা দেওয়া হয়নি। ১৯৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশের ভিসা নামঞ্জুর করার বিষয়টি হাউস অব লর্ডস-এ উপস্থাপন করেন। যা ৪ ফেব্রুয়ারি হাউস অব লর্ডস-এ আলোচিত হয়। ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করেন।

আজ সেই দিন, ১৯৭৯ সালের এইদিনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল বিশ্ববিবেক ও বিশ্বমানবতার কাছে। আজ দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এই কলঙ্কমোচনের প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে সুদূর সুইডেনে। আর, এই সোপান রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং  অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
সূত্র : ভোরের কাগজ

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়