মঞ্জুরুল আলম পান্না : কয়েক বছরে গুম হওয়ার পর ভাগ্যের বদৌলতে যে মানুষগুলো ফিরে এসেছেন, তারা কেউই প্রকাশ্যে কখনো বলেননি যে তাকে গুম করা হয়েছিলো। এমনকি গণমাধ্যমে কোনো কথা পর্যন্তও বলেননি। বরং ফিরে আসার পর তাদের অপ্রকৃতস্থ মনে হয়েছে সবসময়, পৃথিবীকে মনে হয়েছে অচেনা তাদের চোখে। কেন অপ্রকৃতস্থ মনে হয়েছে, কেন তারা অস্বাভাবিক এক ভয়ে মুখ খোলেন না, তা আমরা কেবল উপলব্ধিই করতে পারি। তবে দিনের পর দিন ঘোরতর অন্ধকারে থাকার পর সবার সামনে এসে সাংবাদিক কাজল উচ্চারণ করতে পেরেছেন সেই কঠিন কথাটি, তাকে গুম করা হয়েছিলো। রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ থাকা মানুষটিকে ৫৪ দিনের মাথায় আটক করা হলো নাটকীয়ভাবে। অভিযোগ পাসপোর্ট ছাড়া ভারত থেকে দেশে অনুপ্রবেশের। কিন্তু আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘গুম হয়ে যাওয়া যে কতো কষ্টের, কতো দুর্বিষহ, কতো বেদনার, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না’। অসাধারণ এক দৃঢ় চিত্তের মানুষ বলেই সম্ভবত ভয়াবহ ওই শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পেরেছেন তিনি। ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, জি কে শামীম, নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ কিংবা নারায়নগঞ্জের ৭ খুনের আসামি নূর হোসেনের মতো ভয়ংকর অপরাধী কিংবা করোনার মতো যুদ্ধবস্থায়ও গরিব মানুষের চাল চুরি করা পাতি কোনো জনপ্রতিনিধিকে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরানো না হলেও সাংবাদিক কাজলকে যেভাবে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরানো হলো তা আমাদের চোখে নতুন কিছু নয়। সাংবাদিকদেরই বরং এমন নিষ্ঠুরভাবে হাতকড়া পরানোর বিষয়টিকে একধরনের বীরত্বমূলক কাজ মনে করেন শক্তিমানেরা। কারণ এই রাষ্ট্রের চোখে সাংবাদিকরাই সম্ভবত অনেক বেশি আতঙ্কের, অনেক বেশি হুমকি।
সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের কথা মনে আছে তো? যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কলম ধরায় একটি পা হারানো এক সাংবাদিক। বয়োবৃদ্ধ এই মানুষটিকেও আমাদের দেখতে হয়েছে তার এক হাতে ক্র্যাচ আর অন্য হাতে হাতকড়া। কারণ তার নামে মামলাটি যার হয়ে করা হয়েছিলো তিনি ছিলেন তখনকার একজন মন্ত্রী এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী। সাংবাদিক কাজলকে দেশে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করা হলেও তাকে কারাগারে পাঠানো হলো সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায়। নিঃসন্দেহে শিখরও সরকারি দলের কম প্রভাবশালী সদস্য নয়। যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে ৯ মার্চের মামলার পরদিন থেকে কাজলকে আর পাওয়া যায়নি। অনেকে বলাবলি করছেন, কাজলকে জীবিত ফিরতে দেওয়া হয়েছে, এটিই বরং অপহরণকারীদের বদান্যতা। হয়তো তাই-ই। কোনো রকমে বেঁচে থেকেও আমাদের পরম কৃতজ্ঞ থাকতে হয় রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর কাছে, নতজানু থাকতে হয় আইন ভাঙা আইন প্রণেতাদের অলৌকিক ক্ষমতার কাছে। দীর্ঘ প্রায় দুই মাস পর সন্তানকে কাছে পেয়েও পিছমোড়া হয়ে বেঁধে থাকার কারণে সন্তানকে স্পর্শ করতে পারেন না যে বাবা, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না পরম মমতায়, তার কাছে এই রাষ্ট্রের মূল্য কতোখানি, তা ঠিক জানি না। তবে সত্যের মূল্য যে কাজলদের কাছে জীবনের চেয়েও সত্য, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অমিত সাহসী উচ্চারণে। পেছনে বাঁধা দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুক চিতিয়ে সন্তান মনোরম পলককে সাংবাদিক কাজল বলে উঠেন, ‘ভয় পাসনে বাবা, আমি কোনো অন্যায় করিনি। সত্যের জয় হবে’। লেখক : সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন :