আলী রীয়াজ : সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক কিছু পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এখন দেশের অনেক গার্মেন্টস কারখানা খুলেছে। যদিও ‘আপাতত দূর-দূরান্ত থেকে শ্রমিক না আনতে সদস্য কারখানাকে পরামর্শ দিয়েছে’ পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠনগুলো। বলা হয়েছে, ‘আশপাশে বসবাসরত শ্রমিকদের দিয়ে সীমিতভাবে উৎপাদনকাজ চালাতে’। কিন্তু ২৫ এপ্রিল সারাদেশ থেকেই শ্রমিকরা যে যেভাবে পেরেছেন, এসেছেন। তাদের এই যাত্রা কেমন হয়েছে সেটা জানা। পুলিশের বাধা, গণপরিবহন না থাকা, পুলিশের বাধা এড়াতে রাতের অন্ধকারে চলাচল, গাড়িতে গাদাগাদি করে আসার ঘটনাগুলো বিভিন্ন মাধ্যমেই জানা যাচ্ছে। শ্রমিকরা ভয়ে এসেছেন, যেভাবে পেরেছেন এসেছেন। কেননা তাদের ভয় হচ্ছে ২৬ এপ্রিল সকালে কাজে যোগ না দিলে তাদের চাকরি থাকবে না।
তাদের এই আশঙ্কার একটি কারণ হচ্ছে, ‘আশপাশে বসবাসরত’ কথার কোনো অর্থ কেউ ব্যাখ্যা করেনি। যে শ্রমিকরা ২৬ মার্চের পরে ঢাকার বাইরে গ্রামে চলে গেছেন তার আসলে সারাবছর কারখানার আশপাশেই থাকেন। কারখানার কাগজে তাদের ঠিকানা তো আশপাশেই। ‘আশপাশে থাকা’ সত্ত্বেও যদি তারা কাজে যোগ না দেন, তাদের চাকরি থাকবে এমন নিশ্চয়তা কেউ তো দেননি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ইতোমধ্যেই শ্রমিক লেঅফ- চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকরা সেই অবস্থায় মালিকদের হাতে আর অজুহাত তুলে দিতে চাননি। এই বিপদের সময়ে চাকরি গেলে চাকরি পাওয়া যাবে না সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয় না, শ্রমিক হওয়াই যথেষ্ট। তারা যা করছেন সেটাই স্বাভাবিক। মালিকদের সংগঠনগুলো বলছে যে তারা কারখানা খোলার গাইডলাইন দিয়েছেন মালিকদের।
মালিকদের কেউ তা মানছেন কিনা সেটা কারা দেখবেন সেটা জানা যায়নি। মালিকরা নিয়ম ভাঙছেন কিনা মালিকদের সংগঠন সেটা দেখবে? এ সব গাইডলাইনে আছে কীভাবে কারখানার ভেতরে ব্যবস্থা নিতে হবে। বলা হচ্ছে ‘এলাকাভেদে সীমিত পরিসরে ধাপে ধাপে কারখানা চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ’। সরকার সারাদেশকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলায় আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি এলাকার সঙ্গে আরেকটি এলাকার পার্থক্য কীভাবে নির্ধারিত হবে? এই যে ধাপে ধাপে খোলা হবে তার সূচকগুলো কী? দেশে ভাইরাস পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে থাকলে কতোটুকু খোলা হবে? এই সূচকগুলো কি তৈরি করা হয়েছে? এই প্রশ্নগুলো কেবল গার্মেন্টসের জন্যই প্রযোজ্য তা নয় অন্যদের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। সামাজিক দূরত্ব বা ঘরে থাকার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে অনেকেই বলছেন যে, এই অবস্থায় দোকানপাট-শিল্প কারখানা খুলে দেওয়াই ভালো। কেউ কেউ অর্থনীতির সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কার অজুহাতে বলছেন। কেউ কেউ বলছেন এই যুক্তিতে যে, বাংলাদেশ যদি এখন সরবরাহ চেইন থেকে ছিটকে পড়ে তবে অন্য দেশ সেই জায়গা নিয়ে নেবে। যে যুক্তিতেই বলা হোক না কেন সেগুলো এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় সঠিক নয়। তারা বিস্মৃত হচ্ছেন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ যেখানে সুস্থ্য হওয়ার চেয়ে মৃতের সংখ্যা বেশিÑ ৪৯৮৮ জন আক্রান্ত, সুস্থ হয়েছেন ১১৩ জন, মারা গেছেন ১৪০ জন। এই হিসাব সরকারি, বেসরকারি হিসাবে ‘উপসর্গে’ মারা গেছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করলে কী দাঁড়ায়? যে সব লোকের আক্রান্ত হওয়ার বা মৃত্যুর খবর জানাই যাচ্ছে না তাদের বিবেচনায় নিলে আশঙ্কা যে বাড়ে তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশে এই পর্যন্ত মোট ৪৩ হাজার ১১৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কতো পরিমাণ পরীক্ষা করা হলে বোঝা যাবে যে পরিস্থিতি আসলে কারখানা খোলার উপযোগী সেটা নির্ধারণ না করে ‘ধাপে ধাপে’ খোলার কথা বলা আসলে একধরনের বায়বীয় আলাপ। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারের কোন অনুপাত হলে অর্থনীতির চাকা সচল করা যাবে, সেই সিদ্ধান্ত মালিকদের নেওয়ার বিষয় নয়, সেটা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কাজ। বিভিন্ন ধরনের প্রজেকশনেই দেখা যাচ্ছে এই মাসের শেষ দিকে থেকে মে মাসে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। সেই অবস্থায় কোনো রকম সূচকের অপেক্ষা না করে, সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত কতোটা বিবেচকের কাজ? বাংলাদেশে পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। গণস্বাস্থ্যের তৈরি পরীক্ষা কিটের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চেয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের দিকেই বেশি উৎসাহী দেশের এক শ্রেণির মানুষ। তার সঙ্গে সরকারের আমলারা গলা মিলিয়ে পদ্ধতির বয়ান গাইতে শুরু করেছেন। কিন্তু প্রতিদিন যে সংখ্যায় ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন তার ফলে প্রায় ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা আগামী কয়েকদিন পর কী অবস্থায় দাঁড়াবে কেউ জানেন না। একদিকে বলা হচ্ছে আরও ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দেওয়া হবে, অন্যদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে শত শত সরকারি চিকিৎসক এমনকি তিনমাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। অর্থনীতির চাকা সচল করতে যে উৎসাহ দেখা যায়, তার চেয়েও অনেক কম উৎসাহ হচ্ছে এ সব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার। আরও কম উৎসাহ মানুষকে বাঁচানোর জন্য তাদের কাছে খাবার পৌঁছানোর কাজে। সরকারি হিসাবে পৌনে তিন কোটি মানুষেরর কাছে চাল পৌঁছানোর খবর জানা যাচ্ছে, কিন্তু এই সংকটে এই সাহায্য কাদের হাতে পৌঁছেছে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ত্রাণের চাল চুরির মহোৎসবের খবরের প্রেক্ষিতে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অতি দরিদ্র, নতুন দরিদ্রদের জন্য এ সব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। সারাদেশের যে সব মানুষ এখন কাজের অভাবে ভয়াবহ অবস্থায় আছেন তাদের জন্য কি কেবল কয়েক বেলার চাল দেওয়াই সরকারের কাজ? পোশাক শিল্পের অনেক শ্রমিক বেতন পাননি এই অভিযোগের কি সুরাহা হয়েছে? মালিকদের স্বার্থ এবং বিদেশি বাজারের বিবেচনায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটা কে দেখবে? ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :