হাসিনা আকতার নিগার : সবুজের ছিমছাম গুছানো সংসার । ২ ছেলে, স্ত্রী আর বাবাকে নিয়ে তার পরিবার। চাকরি করে একটা মাঝারি ধরনের কনসাল্টিং ফার্মে । মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে ভালোই আছে সে। যদিও মাসের খরচ মিটিয়ে সঞ্চয় করার মত টাকা থাকে না । কারণ বাসা ভাড়া,খাওয়াদাওয়া, বাচ্চাদের পড়ার খরচ, বাবার ওষুধ, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ সামাল দিয়ে মাস শেষে হাত থাকে শূন্য। আবার অফিসে সব সময় নির্দিষ্ট তারিখে বেতন দিতে পারে না। তখন ধার করে চলতে গিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। কিন্তু ঘর, পরিবার আর বেতনের অংকে সবুজ হলো মধ্যবিত্ত। এ মধ্যবিত্ত জীবন যে কেবল করোনা ভাইরাসের সময় অভিশাপ তা নয়। বরং সারাজীবনের অভিশাপ।
সবুজ ঘরবন্দী জীবনে টানাপোড়েনের মাঝে ভাবছে কী করে চলবে তার আগামী দিন। বাড়ি ভাড়া, স্কুল বেতন সবই বাকী পড়েছে। অফিস আছে সিদ্ধান্তহীনতায়, কাজ আর কর্মচারীদের বেতন নিয়ে। চাকরিটা থাকবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আর সবুজের মত প্রাইভেট অফিসে কাজ করা মধ্যবিত্তের জন্য কোন প্রণোদনা ভাতা বা সুবিধা সরকার দেয়নি। তার অফিস কাজ করে চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। এমনিতেই হাতে কাজ কম ছিলো। তার উপর কোভিড ১৯ দুর্যোগ। বিল না পেলে বেতন হয় না। তাই হাতে আসেনি মাসের বেতন। নির্বাক হয়ে টিভি দেখে সবুজ ভাবে আসলে মধ্যবিত্ত বলে সাহায্য চাইতে লজ্জা নয় যন্ত্রণা হয়।
সবুজের মত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বিপদগ্রস্ত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কারণ এদের আত্মসম্মানবোধ বিবেককে তাড়িত করে। অভাব সহ্য করবে তবু্ও হাত পাতবে না। বিত্তবান বা বিত্তহীনদের মত যে কোন কাজ এরা করতে পারে না। সব সময় একটা প্রশ্ন তাদের সামনে থাকে - সমাজ কী বলবে,মানুষ কী ভাববে ? এ চিন্তায় থাকা মানুষদের সাধারণ অর্থে মধ্যবিত্ত বলা হয়ে থাকে। আসলে এরা উচ্চ আর নিম্নবিত্তের মাঝে পড়া অস্তিত্বহীন একটা শ্রেনি। পরগাছার মত জীবন। তবে বোধশক্তি প্রখর।
কোভিড-১৯ সমাজের তথাকথিত শ্রেনি বিন্যাসকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে মধ্যবিত্ত শব্দটি হলো পুঁথিগত। বাস্তবে এরা না পারে উপরে যেতে না পারে নীচে নামতে। তাই অনেকের ভাষায় মধ্যবিত্তের হলো তারা, যারা নির্ধারিত মাসোহারাতে জীবন পরিচালিত করে। বাড়তি আয়ের কোন উৎস নেই। হিসাবী জীবনে সর্বদা থাকে অনিশ্চিয়তার শংকা।
বাংলাদেশে দারিদ্রসীমার উপরে বাস করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যার প্রমাণ মিলে বিআইডিএস-এর গবেষণা থেকে। ১৯৯১ সালে মধ্যবিত্তের হার ছিল ৯%। যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২০%। গবেষণা মতে এ হার ২০২৫ সালে হবে ২৫% এবং পরবর্তী ৫ বছর অর্থ্যাৎ ২০৩০ সালে হবে ৩৩%। গবেষণাটি আশাব্যঞ্জক হলেও কোভিড-১৯ মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষ করে লেখক সাংবাদিক, শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবি সহ অন্যান্য পেশার মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে চরমভাবে।
করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে ঘর বন্দি জীবনকে এ মুহুর্তে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে সবুজের মত মধ্যবিত্ত মানুষদের। কারণ সাজানো ঘরে নীরবে খাবার দিতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের মনেও প্রশ্ন জাগে এদের অবস্থা দেখে। যিনি ১৫ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেন তার খাবার নাই এটা কী করে সম্ভব। কিছু সঞ্চয় কি তার নেই? আসলে মধ্যবিত্তের ফানুস জীবনটা কতটা নির্মম তা করোনা ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। আর এ নির্মমতায় নীরবে চোখের জল পড়ে কেবল সবুজের মত মধ্যবিত্তদের।
দেশে সরকারী বেসরকারি ভাবে ত্রান দিয়ে মানুষের ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা চলছে। সেখানেও দুর্নীতি অনিয়ম হচ্ছে অতীতের মত । আবার সরকারি আদেশে রেশনিং পদ্ধতির প্রক্রিয়া চলমান। অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে নানা সেক্টরের জন্য। কিন্তু সে প্যাকেজের সুবিধা, ত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ মধ্যবিত্তদের জন্য। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজে ঋন পরিশোধের জন্য চাকরি ব্যবসার নিশ্চয়তা সবার আগে জরুরি। তা না হলে ঋণের বোঝা পরিবারকে আরো বেশি অনিশ্চিয়তাতে ফেলে দিবে।
সারা বিশ্ব কোভিড ১৯ এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুনভাবে চিন্তা ভাবনা করছে। সেখানে ব্যয় সংকোচনের প্রথম শিকার হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীতে মানুষের অর্থনৈতিক সহযোগিতা মুখ্য হলে, সেখানে শ্রেনি বৈষম্য থাকার কথা নয়। অথচ বাংলাদেশে মনে হচ্ছে কোভিড ১৯ এ বিপদগ্রস্ত হয়েছে শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় মধ্যবিত্তে নিয়ে পরিকল্পনা অস্পষ্ট আজ অবধি ।
সাদা চোখে এখনো মধ্যবিত্তের সংকট দেখা যাচ্ছে না। লক ডাউন শেষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বাড়বে মধ্যবিত্ত বেকারের সংখ্যা। আর এ বেকারদের জন্য কোন আগাম পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত নেই। মধ্যবিত্তরা বেশির
ভাগ চাকরি ব্যবসার উপর নির্ভর করে শহরে থাকে বাড়ি ভাড়া করে। ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে সব কিছু শহরকেন্দ্রিক। তারা চাইলেও পারবে না বিকল্প চিন্তা করতে। তাই তাদের কাছে করোনা ভাইরাসের এ সংকট দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদি হবে। চাকরি হারাবার অশনি সংকেত পাচ্ছে অনেকে এখনি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত এ দেশে জবলেস বেকারদের জন্য কোন বেকার ভাতার ব্যবস্থা নাই। চাকরি বা ব্যবসা ছাড়া ব্যাংকও ঋণ দিবে না। সুতরাং মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য এ মুহুর্তে চিন্তা করা প্রয়োজন। অন্য দেশের নিয়ম অনুসরণ করে এদের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। কারণ দেশকে উন্নয়নের পথে গতিশীল রাখতে বেসরকারি খাতের এ মধ্যবিত্তদের মেধা শ্রম বিশাল ভূমিকা রাখে।
লেখক পরিচিতি : কলাম লেখক, ফেসবুক : https://www.facebook.com/hasinaakhtar.nigar
এএস/এসবি
আপনার মতামত লিখুন :