শিরোনাম
◈ জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রস্তাবে মার্কিন ভেটোর নিন্দা ফিলিস্তিনের, লজ্জাজনক বলল তুরস্ক ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের

প্রকাশিত : ২০ এপ্রিল, ২০২০, ০১:১২ রাত
আপডেট : ২০ এপ্রিল, ২০২০, ০১:১২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

[১] দিনে দরকার ২০ হাজার টেস্ট

দেশ রূপান্তর : [২] দেশে কমিউনিটি লেভেলে অর্থাৎ সামাজিকভাবে করোনার সংক্রমণ ঘটছে। কিছুদিন আগেও আক্রান্ত ব্যক্তির কন্টাক্ট ট্রেসিং করা গেলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। আক্রান্তদের মাধ্যমে রোগটি এক জায়গা থেকে অন্যত্র, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্লাস্টার (একটি জায়গায় কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) জোন ঘোষণা করেও সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না। এখন ধীরে ধীরে রোগটির সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্র (এপি সেন্টার) বাড়ছে। সংক্রমণের উৎসও (কার মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে) জানা যাচ্ছে না। ফলে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। নতুন নতুন এলাকায় রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে।

[৩] গতকালও এক দিনে আরও ৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করে আরও ৩১২ জনের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ২৪৫৬ জন হয়েছে। পাশাপাশি গত শনিবারও রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলা নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে সেদিন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত জেলা ছিল ৫৩টি। হটস্পট হিসেবে রাজধানীর মিরপুর ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও কেরানীগঞ্জের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোগতত্ত্ববিদরা দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষার ধরন বদলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আগে যেমন কন্টাক্ট ট্রেসিং করে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেটা আর এখন দরকার নেই। এখন কৌশল বদলাতে হবে। কারণ, কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হয় একজন আক্রান্ত মানুষ আর কাকে কাকে সংক্রমিত করেছেন বা তার থেকে কতজন সংক্রমিত হয়েছেন, সেটা জানার জন্য। সংক্রমণের শেষ ধাপ অর্থাৎ কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তে পরীক্ষা না করে, যে এলাকায় আক্রান্ত পাওয়া যাবে, সেখানে সাধারণ জ্বর বা কাশি নিয়ে এলেও তার পরীক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ সংক্রমিত এলাকায় সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এখন পরীক্ষা হতে হবে ফিভার (জ্বর) কেন্দ্রিক। এ জন্য উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং জেলাভিত্তিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

[৪] এমনকি বিশেষজ্ঞরা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজারের মতো পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, এভাবে পরীক্ষা করা গেলে বোঝা যাবে কোন গ্রামে করোনা রোগী নেই, কোথায় আছে। যেসব গ্রামে পাওয়া যাবে না ধীরে ধীরে সেখান থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া যাবে। কারণ লকডাউন দীর্ঘদিন রাখা যাবে না।

[৫] অন্যদিকে, আক্রান্ত এলাকাগুলোয় কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপরও জোর দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, আক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে পরীক্ষা ছাড়া যেন কোনো ব্যক্তি বেরুতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পরীক্ষা করার জন্য সন্দেহজনকদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতেই হবে। তা না হলে আক্রান্ত এলাকার মানুষ অন্য এলাকাগুলো সংক্রমিত করবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

[৬] স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৫৩টি জেলায় করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ২৬টি জেলা পুরোপুরি আর ২১টি জেলা আংশিক লকডাউন করা হয়েছে। বর্তমানে ১৯টি ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে, আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৬৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ১০টি ল্যাবে পরীক্ষা হয়েছে ১৮৯৫টি ও ঢাকার বাইরে ৭৩৯টি।

[৭] বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষার ধরন কী রকম হওয়া উচিত জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখনো কমিউনিটিতে ব্যাপক আকারে ছড়ায়নি। তবে ছড়িয়েছে। ব্যাপক আকারে যাতে কমিউনিটিতে রোগটি না ছড়ায়, সে জন্য এখন যার মধ্যেই ন্যূনতম উপসর্গ পাওয়া যাবে (জ্বর-কাশি বা শুধু জ্বর) তাদেরই পরীক্ষা করতে হবে। এখন শুধু আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির পরীক্ষা করলেই চলবে না। ফিভার (জ্বর) কেন্দ্রিক পরীক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যেই বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এ ধরনের পরীক্ষা শুরু করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মোট পরীক্ষার ৩০ শতাংশই করোনা আক্রান্ত।

[৮] এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন যদি বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলো ঠিকমতো খোলা থাকত, তা হলে সেখানেও জ্বরকেন্দ্রিক পরীক্ষা করা যেত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তাই সারা দেশে যে প্রায় ১৫ হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। পরীক্ষাটা উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে উপজেলা বা গ্রামে করোনার ঠিক কী পরিস্থিতি সেটা বোঝা যাবে।

[৯] এই বিশেষজ্ঞ বলেন, উপজেলা ও জেলা লেভেলে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার পাশাপাশি সন্দেহজনক ব্যক্তি যদি করোনা আক্রান্ত না হন, তা হলে তাকে ওই জ্বর-কাশি বা অন্য রোগের চিকিৎসা দিতে হবে। এটা করা গেলে মানুষ কেন্দ্রে নমুনা দিতে আসতে উৎসাহ পাবে। এ ছাড়া যেখানে করোনা রোগী পাওয়া যাবে, তার সংস্পর্শে কারা ছিলেন, সেটা জানার জন্য ওই গ্রাম বা এলাকা অন্তত ১৪ দিন কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।

[১০] অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখন ১৯ ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। আমার জানা মতে, মোট ৪১টি সেন্টারে পিসিআর মেশিন বসিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব। একটা ল্যাবে তিনটি পিসিআর মেশিন যদি দিনে চালানো যায়, তা হলে রোজ ২০ হাজার টেস্ট করা সম্ভব। কারণ মেশিনটি তিনবার করে ১৮ ঘণ্টা চলবে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে।

পরীক্ষা ও নমুনা সংগ্রহ বেশি করতে হলে দ্বিগুণ লোকবল লাগবে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, নমুনা সংগ্রহ যারা করছে, তাদের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে। তা হলেই কোয়ালিটি নমুনা আসবে। মনিটরিং ও সুপারভাইজ বাড়াতে হবে। পিপিই দিতে হবে।

[১১] এই বিশেষজ্ঞ বলেন, দিনে ২০ হাজার টেস্ট করলে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো বাংলাদেশের চিত্র পাওয়া যাবে। তখন করোনা নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কারণ লকডাউন বেশি দিন রাখা যাবে না। এতে জনস্বাস্থ্য বিরূপ আকার নেবে। বেশি পরীক্ষা করে যেসব এলাকায় বা গ্রামে বা জেলায় করোনা নেই, সেখান থেকে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেওয়া যাবে।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আরও বলেন, যেসব জেলা বা এলাকা আক্রান্ত, সেখানকার প্রশাসনকে সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানকার লোকজন যাতে পরীক্ষা ছাড়া বেরুতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গার্মেন্টস খুলে দেওয়া ও বন্ধ করা, সাধারণ ছুটির পর যানবাহন বন্ধ করা, বা বড় বড় জমায়েত, এমন সমন্বয়হীন কোনো সিদ্ধান্ত আর নেওয়া যাবে না।

[১২] এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিনই পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিছু বেড়েছে। তবে আরও বাড়ানো দরকার। পরীক্ষা না করালে সঠিক চিত্রটা উঠে আসবে না। সংক্রমণের সঠিক সোর্সও চিহ্নিত হবে না। আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করা এবং পরীক্ষা বাড়াতে না পারলে দেশব্যাপী করোনা আরও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের অবস্থা ভালো নয়। এখনো যদি সঠিক ব্যবস্থা নিতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে।

[১৩] আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ‘অ্যাকটিভ কমিউনিটি সার্ভিল্যান্স’ এর মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করা, রোগীর কাছে ডাক্তার যাবে, ঘরে ঘরে না গিয়ে যদি টেস্টের বিষয়ে না বলা হয়, তাহলে টেস্ট হবে না। মহামারী মোকাবিলা করতে হলে ঘরে ঘরে গিয়ে সবার স্বাস্থ্য সমস্যার কথা শুনতে হবে। এতে করে স্যাম্পল কালেকশন বাড়বে, কেস ডিটেকশন বাড়বে, আইসোলেশন করে সংক্রমণের উৎস নির্মূল করতে হবে, নয়তো এই লকডাউন দিয়ে কাজ হবে না। লকডাউন তুলে নিয়েও তখন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে দেখা যাবে।

[১৪] এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েছি। কিছু কিছু জায়গাতে যেখানে এখনো রোগী নেই কিংবা সংখ্যায় অনেক কম, সেখানেও পরীক্ষা করছি। আবার করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়ার পরও তাদের স্যাম্পল পরীক্ষা হচ্ছে। কারণ তাদের কভিড-১৯ হয়েছিল কি না সেটা নিয়ে সবার মধ্যে দ্বিধা থাকছে। এ দ্বিধা দূর করার জন্যও টেস্ট করা হচ্ছে। এখন আমরা নিউমোনিয়ার রোগীদেরও পরীক্ষা করছি।

[১৫] নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো এলাকা থেকে যদি একাধিক কল আসে, বা সন্দেহজনক ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়, তা হলে সেখানে সবার পরীক্ষা করানো দরকার। এর মাধ্যমে যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে। আর যারা আক্রান্ত নয় তাদের পৃথক করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাবে। এটা করতে না পারলে করোনার প্রাদুর্ভাব আরও বাড়বে। তা ছাড়া সন্দেহভাজনরা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। আবার অনেকে লক্ষণ আড়াল করছেন। এ কারণে সন্দেহভাজন অনেকে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। একই সঙ্গে হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে লক্ষণ থাকা রোগীরা বিষয়টি আড়াল করছেন। আর তাই অধিক পরিমাণে চিকিৎসক-নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা যাতে না হয়, সে জন্য পরীক্ষা বাড়াতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়