শিরোনাম
◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক

প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল, ২০২০, ০৬:২৫ সকাল
আপডেট : ১৫ এপ্রিল, ২০২০, ০৬:২৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঢাকায় রক্তের সংকট, অসহায় স্বজনেরা

প্রথম আলো : থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত তরুণী মনিরা সুলতানার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পাঁচে নেমেছিল। জরুরি রক্ত প্রয়োজন। দিনভর রক্তদাতা খুঁজে হয়রান মনিরা ও তাঁর শ্রমজীবী মা। অন্যান্য সময় খুব একটা সমস্যা হয় না, কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে রক্তদাতাদের অনেকেই হাসপাতালে যেতে রাজি নন।

গত সোমবার একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে মনিরা রক্তদাতার খোঁজ পেলেন, কিন্তু তাঁর বাসা পুরান ঢাকার নারিন্দায়। আর যে হাসপাতালে রক্তদাতা ও গ্রহীতাকে যেতে হবে, সেটি রাজধানীর গ্রিন রোডে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া হাসপাতাল। রক্তদাতা আসতে পারছিলেন না; তাঁর জন্য যানবাহনের ব্যবস্থাও করতে পারছিলেন না মনিরা।

মনিরা সুলতানা বলেন, ‘আমি কয়েকটি জরুরি সেবার নম্বরে যোগাযোগ করেছিলাম। ওনারা বললেন, কারও জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করাটা তাদের আওতার বাইরে। এরপর নানা জায়গায় যোগাযোগ করেছি একটি যানবাহনের জন্য।’

‘আমি না হয় হেঁটে বা রিকশায় তেজগাঁও থেকে গ্রিন রোড যেতে পারব। কিন্তু আমার রক্তদাতাকে নারিন্দা থেকে থ্যালাসেমিয়া হাসপাতালে আনতে ও পৌঁছে দিতে হবে। দিনভর অনেক চেষ্টার পর সন্ধ্যার দিকে জরুরি সেবার একটি গাড়িতে রক্তদাতাকে আনতে পারি,’ বলেন মনিরা।

রক্তদাতা বায়েজিদ আনসারি বলেন, তিনি রক্ত দেওয়ার জন্য তৈরি থাকলেও যানবাহন পাচ্ছিলেন না। এরপর শেষ বিকেলে যখন তাঁকে প্রস্তুত হতে বলা হয়, তখন সন্ধ্যা ছয়টা। এই সময়ে ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। তা ছাড়া হাসপাতালে যাওয়াটা এখন নিরাপদ নয়। কিন্তু তারপরও রক্তদাতার অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বায়েজিদ এ নিয়ে কুড়িবারের মতো রক্ত দিলেন।

মনিরার মতো অনেকেই জরুরি ছুটির মধ্যে রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে সংকটে পড়ছেন। ক্যানসার, ডায়ালাইসিস, অস্ত্রোপচারের রোগীসহ মুমূর্ষু অনেকেই জরুরি প্রয়োজনে রক্ত পাচ্ছেন না। আর্থিক সক্ষমতা থাকলে চড়া দাম দিয়ে কেউ কেউ রক্ত কিনছেন, যদিও এই রক্তের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে দরিদ্র বা কম আয়ের মানুষের পক্ষে রক্ত সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়েছে।

নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের অভাব কমবেশি সব সময় থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে মিলছে না পজিটিভ গ্রুপের রক্তও। রোগীর স্বজনেরা ছুটে বেড়াচ্ছেন এক ব্লাড ব্যাংক (রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র) থেকে অপর ব্লাড ব্যাংকে। সর্বত্রই একই কথা, রক্ত নেই। রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না।

মনিরার প্রতি মাসে তিন ব্যাগ রক্ত লাগে। তেজগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে মায়ের সঙ্গে তাঁর বসবাস। গার্মেন্টসে চাকরির উপার্জনে মা-মেয়ের জীবিকা চলে। তার ওপর এত কঠিন রোগের বোঝা। মনিরা নিজেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। শরীরে থ্যালাসেমিয়া বাসা বাঁধার পর আর কাজ করতে পারেন না।

টাকা হলে রক্ত মেলে
তবে চড়া দাম দিলে মিলছে রক্ত। দাম কমবেশি আড়াই হাজার টাকা ব্যাগ। তবে টাকা জমার রসিদ মিলবে না। বিক্রেতাদের মনোভাব হচ্ছে, নিলে নেন, না নিলে যান। এক রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় রক্ত খুঁজতে চারটি ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করেন এস এম মানিক। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ওই রোগীর জন্য গত শনিবার দ্রুত রক্ত সংগ্রহ করে আনতে বলা হয়। আত্মীয়স্বজন রক্ত জোগাড়ের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু রক্তদাতাদের কেউ হাসপাতালে যেতে রাজি নন।

এস এম মানিক জানান, কোয়ান্টাম জানিয়ে দেয়, ওই সময় দেওয়ার মতো রক্ত তাদের সংগ্রহে নেই। একই বক্তব্য ওরিয়েন্টাল ব্লাড ব্যাংকের। এরপর গ্রিন রোডের একটি ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে এক ব্যাগ রক্তের দাম চাওয়া হয় আড়াই হাজার টাকা। সেখান থেকে পান্থপথের একটি ব্লাড ব্যাংকে গেলে অনেক পীড়াপীড়ি করে এক ব্যাগ রক্ত পেলেও দাম দিতে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা।

সংগ্রহ করে রাখা রক্ত নিয়ে প্রশ্ন সব সময়ই আছে। রাজধানীর বড় হাসপাতাল অথবা হাসপাতালের সংখ্যা যে এলাকায় বেশি, সেখানে ভবঘুরে ও নেশাগ্রস্ত রক্তদাতাদের বিচরণ। একাধিক ব্লাড ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর শ্যামলী, পান্থপথ, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ কিছু এলাকায় ভবঘুরে বা নেশাগ্রস্তদের সঙ্গে ভুঁইফোড় ব্লাড ব্যাংকের যোগাযোগ রয়েছে।

নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করা যাবে না। বর্তমানে ৩১ শতাংশ রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে। বাকিটা আত্মীয়স্বজন ও পেশাদারদের কাছ থেকে।

২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আয়োজিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এতে ২০২০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ঘোষণার প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন দেয় এবং অঙ্গীকার করে। তবে অর্জনটা এখন পর্যন্ত অনেক দূরে।

ঢাকায় দুই ধরনের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে এক ধরনের কেন্দ্র হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যগুলো হাসপাতালের বাইরে শুধু রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ত পরিসঞ্চালন-সংক্রান্ত শর্ত মানে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

মেডিকেল কলেজ বন্ধ থাকায় সংকট
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি কাজ করে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে পরিচালিত সংগঠন সন্ধানী। সংগঠনটি নিজের এবং সহযোগী আরও কিছু সংগঠনের সহায়তায় বছরে সাড়ে সাত লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে। সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি তানভীর হাসান ইকবাল বলেন, এখন মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ থাকায় রক্ত সংগ্রহ কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। তারপরও সন্ধানীর সদস্যরা যে যার অবস্থানে থেকে এই কাজ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রক্তদাতা হাসপাতালে যেতে চান না, আবার যেতে চাইলেই তাঁদের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর দাবি সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি রক্তের প্রয়োজনে যানবাহনের ব্যবস্থা করা। এর পাশাপাশি রক্তদাতাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তা না হলে মানুষ এত যুদ্ধ করে ঘর থেকে বের হতে চাইবে না।

সোমবার সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তানভীর হাসান বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা একজন রোগীর জন্য তাঁরা দিনভর চেষ্টা করছিলেন। রক্তদাতাদের খোঁজ পেলেও তাঁরা হাসপাতালে যেতে চাননি, দু-একজন যেতে চাইলেও স্বজনেরা পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। মুমূর্ষু রোগীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ওই সময়ে দায়িত্ব পালন করা একজন চিকিৎসক নিজেই রক্ত দেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে রক্তের সংকটে করণীয় বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ আছে কি না, তা জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। প্রত্যেকের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা হয়, এরপর মুঠোফোনে বিষয়টি জানিয়ে খুদে বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু জবাব পাওয়া যায়নি।

ব্লাড ব্যাংক যা বলছে
ওরিয়েন্টাল ব্লাড ব্যাংকের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, বেসরকারি হাসপাতালে রোগী না থাকায় রক্তের চাহিদা খুবই কম। কিন্তু জরুরি রোগীদের জন্য যেটুকু চাহিদা আছে, তাও মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁদের ব্লাড ব্যাংকে রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হয় না। রক্তদাতা ও গ্রহীতার ক্রসম্যাচিং, স্ক্রিনিংসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে ১ হাজার ২০০ টাকা নেন তাঁরা।

মুক্তি ব্লাড ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফ জানান, রক্তের চাহিদা আসছে কম, কিন্তু যেটুকু আসছে, তাও পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তদাতা খুঁজে পেতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। যে কারণে আগে যে দাম রাখা যেত, এখন তার চেয়ে বেশি রাখতে হচ্ছে; যদিও টাকার অঙ্ক তিনি বলেননি।

সামনে সংকট বাড়বে
পুলিশের হিসাবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এক কোটিরও বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী বা তরুণ। তাঁদের মধ্যে অনেক রক্তদাতা আছেন। এ ছাড়া ঢাকায় এখন যেসব রক্তাদাতা আছেন, তাঁদের অনেকেই হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাঁদের হাসপাতালে যাওয়ার অনুরোধ করাটাও কঠিন। রক্তের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রক্তদান কর্মসূচি আয়োজন করে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে আয়োজন করা এই কর্মসূচি প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ।

রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ অপেক্ষায় থাকা রক্তদাতাদের রোগী খুঁজে দেওয়ার কাজটি করে। এর অন্যতম উদ্যোক্তা নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন রক্তদান কর্মসূচি আয়োজন করে থাকে, মঙ্গলবার কোনো কর্মসূচি ছিল না। রোজার মাসে সাধারণত রক্তদান কর্মসূচি বন্ধ থাকে। নিয়মিত চাহিদার পাশাপাশি সামনে ডেঙ্গু মৌসুম। তাই রক্তের সংকট আরও প্রকট হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়