শিরোনাম
◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা ◈ ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দ্রুত আরোপ করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ ◈ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত ◈ বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ ও মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করে যাবে যুক্তরাষ্ট্র: ম্যাথিউ মিলার ◈ ঈদের পর কমপক্ষে ২৩ ডিসি’র রদবদল হতে পারে ◈ ৫ থেকে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে কর্মদিবস একদিন

প্রকাশিত : ১৩ এপ্রিল, ২০২০, ০৬:১৫ সকাল
আপডেট : ১৩ এপ্রিল, ২০২০, ০৬:১৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমীর খসরু : ওরা কেউই আসবে না…

আমীর খসরু: করোনা বা কোভিড-১৯’র ক্রমবিস্তারী পরিস্থিতির মধ্যে এখন পুরো বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে ৩১ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেস করোনা সম্পর্কিত এক বক্তব্যে জোরালো ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, আমরা যতোই নিজেদের শক্তির বড়াই করি না কেন, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মহাদুর্বলতাই আসল সত্যটি উন্মোচিত করেছে’। মানবজমিন

যে পরিস্থিতির মধ্যে, যে অবস্থার মধ্যে এই লেখাটি লিখছি, সে সময় প্রতিমুহুর্তে ওই শক্তির বড়াইয়ের কারণে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত আমজনতাকে জীবন দিতে হচ্ছে। আসলে বলতে হয়, বিদ্যমান ব্যবস্থাই তাদের হত্যা করেছে, করছে। করোনার সংক্রমণে নিহত বা সংক্রমিত মানুষগুলো এর অসহায় শিকার। যে শক্তি ও দম্ভের কথা জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, তা মূলত শাসকদের নিজ নিজ দেশের সামরিক শক্তি এবং সামরিক ব্যয় ও নিত্যদিনের উন্নততর মারণাস্ত্র আবিষ্কার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা SIPRI-(সিপরি) তাদের গবেষণায় বলছে, পুরো বিশ্বে ২০১৮ এবং ২০১৯-এ সামরিক খাতে ব্যয় করা হয়েছে অন্তত ৪ লাখ কোটি ডলার। প্রতিবছরই সামরিক খাতে এই ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞগণ বলছেন-যুদ্ধ চান বা নাই চান, বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে আজকের জন্ম নেওয়া শিশুটিকেও ২৫০ ডলার সামরিক খাতের দায় বা দেনা মাথায় নিয়েই পৃথিবীতে আসতে হয়েছে। যতোদিন বাঁচবেন ততোই আপনার এই দেনা বাড়তে থাকবে।

অন্য একটি হিসেবে দেখা গেছে, বিশ্বের উন্নত মাত্র ১০টি দেশের ২০১৯ সালের সামরিক বাজেট ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি ডলার। বাস্তবে ব্যয় করা হয়েছে অনেক অনেক গুণ বেশি। অন্য একটি তথ্য যদি দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে- ওই অস্ত্র বিক্রয়কারী ১০টি বৃহৎ দেশ ২০১৮ সালে শুধুমাত্র প্রচলিত বা কনভেনশনাল অস্ত্র বিক্রয় করেছে ২ হাজার ৫শ’ কোটি ডলার। ছোট-বড় সব মিলিয়ে এই পরিমাণ অনেক অনেক গুণে বেশি। এছাড়া ২০১৮ সালে ১০টি দেশ- যাদের কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে- তারা অস্ত্র কিনেছে ১৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। এগুলো প্রকাশ্য তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে হিসেব করা হয়েছে। অস্ত্র বিক্রির দুনিয়ায় প্রকাশ্যের চাইতে অপ্রকাশ্য দিকটিই বেশি থাকে। এই হিসেবে বছরে কয়েক লাখ কোটি ডলারের সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের ঘটনা ঘটছে।

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ Joseph E. Stiglitz and Harvard professor Linda J. Bilmes তাদের The Three Trillion Dollar War: The True Cost of the Iraq Conflict -নামে ২০০৮-এর ফেব্রুয়ারিতে একাটি বই প্রকাশ করা হয়। আর ওই বইটিতে ইরাক যুদ্ধে ৩ লাখ কোটি ডলার খরচের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বইয়ে ইরাক যুদ্ধে ব্যয়কৃত অর্থ যে জনগণের ট্যাক্সের অর্থের অপচয় সে কথাও বলা হয়েছে। এভাবে বর্তমানকালে চলমান বিভিন্ন যুদ্ধের পেছনে কত ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ব্যয় করা হয়েছে বা হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এতো গেল সরাসরি সামরিক খাতের ব্যয়, অস্ত্র কেনা-বেচার প্রকাশ্য হিসাব। কিন্তু আনবিক বোমাসহ নানা ধরনের যে নিত্য-নতুন অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে তাতে কত হাজার, কত লাখ কোটি ডলার অর্থ ব্যয় হয় তার হিসাব রাখাও কঠিন; এ তথ্য আমরা পাইও না, কোনদিন পাবোও না। কারণ জনগণের ট্যাক্সের অর্থে বিশ্বব্যাপী যে সামরিক ব্যয় এবং সমরাস্ত্র কেনা হয় তার তথ্য জানা জনগণের জন্য নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে চিন্তা নিষিদ্ধ, কণ্ঠ নিষিদ্ধ।

আমরা অনেকেই বায়লোজিক্যাল ওয়্যারফেয়ার বা জীবাণু যুদ্ধের কথা জানি। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা আশংকা করছে- ইবোলা, এ্যানথ্রাক্স, লাসা জ্বরের মতো ভাইরাস জীবাণু যুদ্ধের ফসল। কিন্তু এটা এতোটাই গোপন যে, এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। এতে লাখ লাখ কোটি ডলার খরচ করে সাধারণ মানুষ বিনাশী এই অস্ত্র প্রয়োগ চলছে? সাম্প্রতিককালে এমন চিন্তা অনেকে করছেন যে, করোনাও এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। জাতিসংঘের তথ্য-উপাত্ত ঘাটাঘাটি করলে দেখা যাবে, ১৯৭২ সাল থেকে এই দীর্ঘ সময় ধরে জীবাণু যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে নানা আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে, ৯ দফা রিভিউ মিটিং হয়েছে সত্য-কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এতোক্ষণ ধরে সামরিক ব্যয়, সমরাস্ত্র বিক্রয় বা ক্রয়ের যে তথ্যাদি দেয়া হয়েছে তার প্রধান কুশীলব যে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর সরকার তা নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে বড় বড় করপোরেট কোম্পানী, আর অস্ত্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।

সামরিক ব্যয়, সমরাস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়সহ এ জাতীয় তথ্য এ কারণে উপস্থাপিত হলো যে, যে অর্থ যুদ্ধের নামে, নিরাপত্তার নামে, মানুষ মারার কাজে ব্যবহার করা হয় বিশ্বজুড়ে, তার সামান্য অর্থ দিয়েই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ও চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা যায়। সবসময়ই পুরো দুনিয়ার তথাকথিত গণতান্ত্রিক অথবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা বলে থাকেন, সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরনে সদা ব্যস্ত। কিন্তু বাস্তব কী তাই বলছে? তাহলে আমরা বিশ্বস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে পারি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৯-এর তথ্যমতে, চিকিৎসাবিহীন বা অতি দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোতে প্রতিবছর কমপক্ষে ৮ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন। এছাড়া ৫৪ লাখ শিশু ৫ বছর বয়স হতে না হতেই মুত্যুবরণ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দূরাবস্থার কারণে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনুন্নত ও দরিদ্র দেশে শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষের গড় দৈনিক আয় ৬ ডলারের সামান্য বেশি: বাকীদের অবস্থা তলানীতে। এসব অনুন্নত দেশে প্রতি এক হাজার জনে চিকিৎসক রয়েছে গড়ে মাত্র দশমিক ৩ থেকে ৫ শতাংশ। উন্নত দেশে এই সংখ্যা ৫ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত। অনুন্নত দেশের হাসপাতালে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য শহর এলাকায় বেড আছে মাত্র ৫ থেকে ৬টি। আর উন্নত দেশে প্রতি হাজারে আছে ওই সংখ্যার অনেক অনেক গুণে বেশি।

লেখার প্রথমেই বলেছিলাম, করোনা আসলে আমাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার মহাদুর্বলতাকেই পুনরায় প্রমাণ করেছে। বিশ্বে প্রতিবছর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পেছনে নামমাত্র ব্যয় হয়। যদিও বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সত্যিকারভাবে অগ্রাধিকার যদি দেয়া হতোই তাহলে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন করুণ চিত্রটি আমাদের দেখতে হতো না। করোনা আবার প্রমাণ করেছে যে, উন্নত দেশের জনস্বাস্থ্যসহ তামাম দুনিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আসলে কতোটা দুর্বল এবং ভঙ্গুর। এক কথায় দুনিয়া জুড়ে জনগণ তাদের শাসকদের কাছে আসলে কতোটা মূল্যহীন!

একথাটি বলা প্রয়োজন যে, শাসককূল জনগণকে মূল্যহীন মনে করে বলেই উন্নত-অনুন্নত দেশগুলোর শাসকরা করোনা সংক্রমণের শুরুতে একে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, পরিস্থিতি আড়াল করার চেষ্টা করে আসলে হত্যা করেছে অসংখ্য মানুষকে। করোনা আবার প্রমাণ করেছে শাসককূলের কাছে জনগণ আসলেই শাসিত এবং তারা শাসক। তারা যা বলবেন তাই হবে, তাই সত্য। দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভ্যালি ১৫১৩ সালে লিখিত তার বিখ্যাত দ্য প্রিন্স-এ রাজাকে এই মর্মে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, ‘অঙ্গীকার ভঙ্গকারী রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে অঙ্গীকার ভঙ্গের মুহ‚র্তের কার্যাবলীর ওপর এমন এক সত ও সাধুতার রঙ চড়াতে হবে, যাতে করে কেউ যেন তার এ প্রবঞ্চনার এতোটুকু আঁচ করতে বা বুঝতে না পারে’।

কিন্তু একথাটি বলতেই হবে যে, বিশ্বে মাত্র এক বছরের সামরিক ব্যয়, অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় ও যুদ্ধ ব্যয়ের অর্ধেক বন্ধ রাখা হলে পুরো দুনিয়ার স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মানুষের চেহারা পাল্টে দেয়া যায়, পাল্টে দেয়া যায় সমাজ ও পৃথিবী। কিন্তু শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই এটা করবে না। কারণ এটা তাদের ব্যবস্থার জন্য অসম্ভব ও বিপরীত। মানুষ স্বাস্থ্যবান হলে, শিক্ষিত হলে-মানুষ অধিকার সচেতন হলে, তাদের তথাকথিক গণতন্ত্র টিকবে না, টিকতে পারে না। তাবৎ শাসককূল চায়, যেমনটি জর্জ অরওয়েল (George Orwell, 1984) ‘নাইন্টিন এইট্টি ফোর’ বইয়ে বলেছিলেন ঠিক তেমনটি। জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন- “War is peace / freedom is slavery/ Ignorance is Strength. অর্থাৎ ‘যুদ্ধের অপর নাম শান্তি/ স্বাধীনতা ও মুক্তির অর্থ হচ্ছে দাসত্ব/ আর অজ্ঞতা হচ্ছে শক্তি’। শাসকরা চায় জনগণ এমনটা বিশ্বাস করুক।

তবে এটিও সত্য যে, জনগণ এসবের বিপরীতে একদিন জেগে উঠবেই, বলে উঠবে ‘‘যুদ্ধ বুঝ, কিন্তু করোনা বুঝ না’’? কারণ করোনার দুঃখ-বেদনা, শোক-হতাশা, হারানোর কাতরতা, বিপন্নতা সবকিছুই এই শিক্ষাটি জনগণকে, আমজনতাকে দিয়ে যাচ্ছে- আসলেই শাসকরা দাম্ভিক, তবে তাদের শাসন বড় দুর্বল। এদের দম্ভ আসলেই কতোটা না ঠুণকো! করোনার কাছ থেকে জনগণ এই শিক্ষাটিও পেয়েছে- শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই-সংগ্রাম করেই বাঁচতে হবে, বাঁচতে হয়। কারন ওরা কেউই আসবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়