শিরোনাম
◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা ◈ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত

প্রকাশিত : ০১ এপ্রিল, ২০২০, ০৯:৩৪ সকাল
আপডেট : ০১ এপ্রিল, ২০২০, ০৯:৩৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এপ্রিল ফুল উদযাপন : ইতিহাস কী বলে?

পশ্চিমাদের অন্ধ আনুগত্যের প্রবণতা আমাদের সমাজে যেসব প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছে তার অন্যতম হল, এপ্রিল ফুল উদযাপন। এই প্রথার অধীনে এপ্রিলের প্রথম তারিখে মিথ্যা বলে কাউকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোকে শুধু বৈধ মনে করা হয় না; বরং একে রীতিমত একটি কৃতিত্ব মনে করা হয়। যে যত বেশি নিপুণ এবং চতুরতাপূর্ণভাবে অন্যজনকে বড় ধোঁকা দিতে পারে তাকে তত অধিক প্রশংসার যোগ্য এবং পহেলা এপ্রিল পালনে, এর আনন্দ উদযাপনে যথাযোগ্য সফল বলে মনে করা হয়!

মানুষকে ধোঁকা দেয়ার এই রুচি–যাকে সত্যিকার অর্থে অপরাধ ও কুরুচিপূর্ণ কর্মই বলা উচিত–জানা নেই, এতে কত মানুষের জান-মালে অনর্থক ক্ষতি সাধন হয়। এমনকি এর পরিণামে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে! ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাতে গিয়ে তাকে এমন মর্মবেদনা ও পীড়াদায়ক মিথ্যা দুঃসংবাদ শুনিয়ে দেয়া হয়, যা সইতে না পেরে তাকে হার্টএট্যাক করতে হয় কিংবা জীবন থেকে বিমুখ হয়ে সে নৈরাশ্যের অতলে হারিয়ে যায়।

এই প্রথা–যার উৎস ও মৌলিক ভিত্তি হল, মিথ্যা, প্রতারণা আর কোনো নিরপরাধ মানুষকে অহেতুক যন্ত্রণা দেয়া ও বোকা বানানোর উপর, তা কতটা অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না; উপরন্তু এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ওইসব লোকের জন্য খুবই লজ্জাজনক যারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পবিত্রতার ওপর সামান্যতমও ঈমান রাখে।

এই জঘন্য প্রথাটির সূচনা কিভাবে হল?

এই জঘন্য প্রথাটির সূচনা কিভাবে হল; এ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের ব্যাখ্যা-বিবৃতি বিভিন্ন রকম। কোনো লেখকের বক্তব্য হল, সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে সাল বা নববর্ষের সূচনা জানুয়ারীর পরিবর্তে এপ্রিলের মাধ্যমেই করা হত। রোমানরা এই মাসকে তাদের দেবী ভেনাসের (venas) প্রতি সন্মন্ধযুক্ত করে পবিত্র বলে গণ্য করত। গ্রীক ভাষায় ভেনাসের অনুবাদ Aphrodite করা হত। সম্ভবত গ্রীক ভাষার এ শব্দ থেকে উদ্ভব করে পরিবর্তিতভাবে মাসের নাম এপ্রিল করা হয়েছে। (ব্রিটানিকা, পঞ্চদশ সংস্করণ, খ ০৮ পৃ ২৯২)

এজন্য এ সম্পর্কে অনেক লেখকের বক্তব্য এটাই যে, যেহেতু পহেলা এপ্রিল বছরের প্রথম তারিখ এবং এর সঙ্গে মূর্তিপূজার ভক্তি-বিশ্বাসও জড়িত ছিল তাই এই দিবসকে মানুষ ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করত, হাঁসিঠাট্রা করাও ছিল সে আনন্দের বিশেষ একটি অংশ– যা ক্রমশ উন্নীত হয়ে এপ্রিল ফুলের অবয়ব ধারণ করেছে। কেউ কেউ বলেন, আনন্দ উদযাপনের এই দিনে মানুষ একে অপরকে উপহার-উপঢৌকন দিত। একবার জনৈক লোক উপহারের নামে নিছক তামাশা করে। অবশেষে যা অন্য লোকদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রথায় পরিণত হয়।

ব্রিটানিকা এ প্রথার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছে যে, ২১ মার্চ থেকে মোসুমি পরিবর্তন আসতে থাকে। এ পরিবর্তনকে কিছু লোক এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে কৌতুক করে আমাদেরকে বোকা বানাচ্ছে। এজন্য তখনকার মানুষেরা একে অপরকে বোকা বানানো আরম্ভ করে। (ব্রিটানিকা, খ ০১ পৃ ৪৯৬)

তবে একথা এখনও দুর্বোধ্যই রয়ে গেছে যে, প্রকৃতির কৌতুকের প্রতিক্রিয়া হিসাবে উক্ত প্রথার প্রচলন ঘটানোর দ্বারা প্রকৃতির অনুকরণ উদ্দেশ্য ছিল নাকি তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা উদ্দেশ্য ছিল?

প্রধান ও বিশুদ্ধ মত

এপ্রিল ফুল পালনের প্রধান ও বিশুদ্ধ কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বিশ্বকোষ ইন্সাইক্লোপেডিয়া অব লারূস বর্ণনা করেছে এবং এটাকেই যথার্থ কারণ বলে সাব্যস্ত করেছে। তা হল, প্রকৃতপক্ষে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বর্ণনানুপাতে ১লা এপ্রিল হচ্ছে সেই তারিখ যে তারিখে ইহুদি এবং রোমানরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে ঠাট্রা-বিদ্রূপের পাত্র বানিয়েছিল। বর্তমানে প্রচলিত নামসর্বস্ব ইঞ্জিলগুলোর মধ্যেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। এ সম্পর্কে লুক-এর ইঞ্জিলের ভাষ্য এরকম—

‘যে ব্যক্তি তাঁকে (ঈসা আলাইহিস সালামকে) বন্দি করে রেখেছিল সে তাঁকে মারধর করত। তাঁর সঙ্গে ঠাট্রা-বিদ্রূপ করত। চোখ বন্ধ করে তাঁর গালে চড়-থাপ্পড় মারত এবং তাঁকে এই বলে জিজ্ঞেস করা হত যে, নবুওয়ত বা ইলাহামের মাধ্যমে বল, তোমাকে কে মেরেছে? এভাবে বিদ্রূপ করে আরো অনেক কথা বলা হত। (লুক ২২: ৬৩-৬৫)

ইঞ্জিলসমুহে একথাও আলোচনা করা হয়েছে যে, প্রথমে ঈসা আলাইহিস সালামকে ইহুদিদের নেতা ধর্মীয় পণ্ডিতদের উচ্চ আদালতে পেশ করা হয়। তারপর সেখান থেকে তাঁকে পিলাতোসের আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। পিলাতোস তাঁকে হিরোডোসের আদালতে পাঠিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত হিরোডোস তাঁকে বিচারকার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পিলোতোসের আদালতে প্রেরণ করে।

লারূসের ভাষ্য হল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এক আদালত থেকে অন্য আদালতে এভাবে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য তাঁর সঙ্গে পরিহাস করা এবং তাঁকে পীড়া দেয়া। আর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ১লা এপ্রিলে, তাই এপ্রিল ফুলের প্রথা মূলত এই লজ্জাজনক ঘটনার স্মৃতি।

এপ্রিল ফুল পালন করতে গিয়ে যাকে নির্বোধ বানানো হয়, ফরাসি ভাষায় তাকে বলা হয় Poisson davril ইংরেজি অর্থ হল, April Fish অর্থাৎ, এপ্রিলের মাছ। (ব্রিটানিকা, খ ০১ পৃ ৪৯)

এর মানে যাকে ১লা এপ্রিলে বোকা বানানো হয় সে যেন এপ্রিলের সুচনায় প্রথম শিকারি মাছ। তবে লারূস তার উপরোক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে একথাও বলেছে, Poisson শব্দটি- ইংলিশে যার অর্থ হয়, Fish তথা মাছ- মূলত এধরণেরই আরেকটি ফরাসি শব্দ Posion এর বিকৃত রূপ। যার অর্থ পীড়া দেয়া, শাস্তি দেয়া। আর খ্রিষ্টানদের বর্ণনা মতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে যে কষ্ট ও শাস্তি দেয়া হয়েছিল, মূলত তারই স্মারক হিসেবে প্রথাটি উদযাপন করা হয়ে থাকে।

অপর এক ফরাসি লেখক বলেন, Poisson শব্দটি তার মূল রূপেই আছে। তবে মূলত শব্দটি পাঁচটি শব্দের প্রথম শব্দ দ্বারা গঠন করা হয়েছে। ফরাসি ভাষায় যে শব্দগূলোর অর্থ হয় যথাক্রমে- ঈসা, মসীহ, আল্লাহ, বেটা, ফিদয়া। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ফরিদ ওয়াজেদিকৃত আরবি ইন্সাইক্লোপেদিয়া দায়েরাতু মাআরিফুল কুরআন পৃ২১, ২২, খ ১ দ্রষ্টব্য)

সুতরাং এ লেখকের মন্তব্যও যেন এই যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে কষ্ট দেয়া ও তাঁকে নিয়ে যে উপহাস খেলা হয়েছিল তারই স্মৃতিস্বরূপ এপ্রিল ফুলের উদযাপন।

খ্রিষ্টানরা কেন এটি উদযাপন করে?

যদি কথাটি সত্যি হয়–যা লারূস ও অন্যন্যরা সর্বাধিক দৃঢ়তা ও প্রামাণিক বর্ণনার সঙ্গে উল্লেখ করেছে–তাহলে এটাই অনেকটা বাস্তবতা যে, প্রথাটির প্রচলন ইহুদিরাই করেছে। উদ্দেশ্য, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পরিহাস করা। কিন্তু অবাককরা ব্যাপার হল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে বিদ্রূপ করার নিমিত্তে ইহুদি কর্তৃক প্রচলনকৃত প্রথাটি -নাউযুবিল্লাহ- কোটি কোটি খ্রিস্টান নির্বিকার ও ঠাণ্ডা মস্তিস্কে শুধু গ্রহণই করে নি; বরং তারা নিজেরাই সে প্রথা পালনে এবং তার আনন্দ উদযাপনে অংশীদার হয়েছে। এর কারণ হয়ত এ হতে পারে যে, খ্রিস্টানরা প্রথাটির অন্তর্নিহিত উৎস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তারা এর উৎস না খুঁজে কেবলই অজ্ঞতাবশত বোকার মত এটি উদযাপন করা আরম্ভ করে দিয়েছে। আবার এও হতে পারে যে, খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসকিতা বিস্ময়কর ও আলাদা। যেমন, তাদের ধারণা মতে যে ক্রুশে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলী দেয়া হয়েছে, বাহ্যত যুক্তির কথা হল, তা তাদের চোখে ঘৃণ্যবস্তু হবে। কেননা এর মধ্যমেই তো তাদের নবীকে নির্যাতন করা হয়েছিল। অথচ অবাক কাণ্ড যে, খ্রিস্টানরা এটাকেই পবিত্রতার প্রলেপ দেয়া শুরু করেছে। ফলে বর্তমানেও এই ক্রুশকে তাদের ধর্মের পবিত্রতা ও মর্যাদার সব চাইতে বড় প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একজন মুসলিম এটি উদযাপন করতে পারে না কেন?

উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা এটা অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এপ্রিল ফুলের প্রথাটি ভেনাস (venas) নামক দেবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হোক কিংবা একে প্রকৃতির রুচি পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া বলা হোক অথবা –আল্লাহর কাছে পানাহ চাই- এটি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে বেয়াদবিপূর্ণ আচরণের স্মৃতি হোক; সর্বাবস্থায় এই প্রথার সম্পর্ক কোনো না কোনো অলিক পূজা কিংবা হঠকারিতাপূর্ণ মতবাদ বা ঘটনার সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু একজন মুসলমানের দৃষ্টিতে প্রথাটি নিম্নোক্ত পাপসমুহের সমষ্টি—

১. মিথ্যা বলা।

২. ধোঁকা দেয়া।

৩. অপরকে কষ্ট বা যন্ত্রণা দেয়া।

৪. এমন একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করা যার ভিত্তি মূর্তি পূজা, অলিক ঘটনা কিংবা আল্লাহর একজন মহান নবীর সঙ্গে বেয়াদবিপূর্ণ আচরণ।

এবার একজন মুসলিম হিসেবে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিন যে, প্রথাটি পালন করে মুসলিমসমাজে এর প্রচলন ঘটানো উচিত হবে কি? যে মুসলিম এর উৎস, স্বরূপ ও এর অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করবে সে ইনশাআল্লাহ অবশ্যই এ থেকে বিরত থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে।

 

মূল: শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী ।।

অনুবাদ: মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী ।।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়