আরজু আহমেদ : নবুওয়তের ষষ্ঠ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের দাওয়াতকে থামিয়ে দিতে কুরাইশরা হেন কোনও পদক্ষেপ ছিল না- যা তারা ততদিনে নেয় নি। কিন্তু আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়াসাল্লামকে নিবৃত্ত করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
কুরাইশ নেতাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ছিল মক্কার লোকদের থেকে তাঁকে আইসোলেট করা। কিন্তু চাচা আবু তালিবের জন্য তা সম্ভব হচ্ছিল না। তারা আবু তালিবকে বললো, যেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরাইশদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
আবু তালিব তাৎক্ষণিক এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবের লোকদের কা'বার সামনে উপস্থিত হতে বলেন। আর তাদেরকে শপথ করান, যেন সম্মিলিতভাবে তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুরক্ষা দেয়।
প্রত্যেকেই স্বগোত্রের অপর একজনের নিরাপত্তার জন্য এই শপথ করলেও আবু লাহাব এতে দ্বিমত করেন। তিনিও অবশ্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা ছিলেন। সে কুরাইশদের সঙ্গে যোগ দেয়।
এবার কুরাইশ গোত্রপতিরা সিদ্ধান্ত নেয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়াসাল্লামের পক্ষে যাঁরাই অবস্থান নেবে তাদের প্রত্যেকের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের।
কুরাইশ নেতাদের সেই বৈঠকের রেজুলেশন লিখেন বাগিদ বিন আমির বিন হাশিম। সেখানে উল্লেখ ছিল-
i. কেউ তাদের কারো সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।
ii. তাদের সাথে মেলামেশা বা কোনও প্রকার সম্পর্ক রাখা হবে না।
iii. সব ধরণের লেনদেন ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে।
iv. এই দুটো গোত্র যতদিন না রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের হাতে তুলে না দিচ্ছে ততদিন কোনও প্রকার সন্ধি বা শান্তি চুক্তি তাদের সঙ্গে করা হবে না।
কুরাইশ নেতারা এতে স্বাক্ষর করে। এরপর তা কা'বার সামনে জনগণের উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ততদিনে নবুওয়তের সপ্তম বছর উপনীত হয়েছে। এর লেখক বাগিদ বিন আমির বিন হাশিমের হাত প্যারালাইজড হয়ে যায়।
বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবকে মক্কা নগরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে এই গোত্রের মুসলিম, অমুসলিম, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু প্রত্যেকেই শহরের বাইরেই এক সংকীর্ণ উপত্যকায় আশ্রয় নেয়। যে উপত্যকাটি পরে আবু তালিবের নামে পরিচিতি পায়।
খাদ্যের মজুদ কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। খাদিজা রা. তাঁর সমস্ত অর্থ ব্যয় করে ফেলেন। বাকি ধনীব্যক্তিদের অবস্থাও ছিল একইরকম। খাদ্যসংকট এত প্রবল হয় যে, জীবনরক্ষায় গাছের বাকল ও পাতা খেতে বাধ্য হয় সবাই।
ব্যতিক্রম ছিল কিছু দয়াদ্র কুরাইশ। তাঁরা গোপনে খাদ্য পৌঁছাতেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। এতদস্বত্ত্বেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সেখানে অবরুদ্ধ কারোর দৃঢ়তায় কোনও ঘাটতি ছিল না।
এইরকম কঠিন সময়েও আল্লাহ্ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের দাওয়াত বন্ধ করেন নি। বিন্দুমাত্র দমে যান নি। তিনি আল্লাহ্র জন্য সবর করেন।
কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু মানবিক হৃদয়ের মানুষ আগে থেকেই এই চুক্তিকে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। এই দুর্দশা তাদেরকে আরও দূর্বল করে।হিশাম ইবনে আমরের নেতৃত্বে জনাপাঁচেক নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি ঐক্যবদ্ধ হন।
পরেরদিন মক্কায় কা'বায় জড়ো হওয়া লোকদের সামনে এগিয়ে যান তাঁরা। যুহাইর ইবনে আবি উমাইয়া, সাতবার কা'বা প্রদক্ষিণ করেন। এরপর লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন,
'ও মক্কাবাসী, আমরা খাব, পরব আর বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালিব অনাহারে থাকবে, কাতরাবে এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে? আল্লাহর কসম আমি এই অন্যায় ফরমান ছেঁড়ার আগ অবধি বসব না।'
তিনি সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফাত ভাই ছিলেন। এরপর তাঁদের মধ্যকার বাকি চারজন সঙ্গীও তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সে সময়ে যে পাঁচজন কুরাইশ এতে একমত হয়েছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন-
১। যুহাইর ইবনে আবি উমাইয়া।
২। যামা'হ বিন আল আসওয়াদ।
৩। আল-বাখতারি।
৪। হিশাম বিন আমর।
৫। আল-মুতিম বিন আদি।
ইতোমধ্যে হট্টগোল চলাকালে আবু তালিব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। আর বলেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এই মর্মে ওয়াহি নাজিল করেছেন যে সেই ফরমানটি ইতোমধ্যে পোকায় কেটে ফেলেছে। কেবল সেখানে আল্লাহর নামের অংশ অবশিষ্ট রয়েছে।
তিনি কুরাইশদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন আর বলেন, যদি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবে তিনি আর আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরাশদের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না।
আর যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তবে কুরাইশদের এ অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে। কুরাইশরা তাঁর দেওয়া এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
এরপর দ্রুত সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পেল, 'বিসমিকা আল্লাহুম্মা' ব্যতীত সমস্ত অংশই পোকায় কেটে ফেলেছে। এরকম স্পষ্ট দৃষ্টান্তের পরও কিন্তু কুরাইশরা ঈমান আনে নি এবং ইসলামের প্রতি শত্রুতাও ত্যাগ করে নি। কেবল অবরোধটুকু প্রত্যাহার করেছিল।
ঈমান আসলে প্রমাণের অপেক্ষা করে না। আর নানান প্রমাণ দিয়ে তা হয়ও না। যুক্তি দিয়েও কারোর হিদায়ত করা যায় না। যদি না ব্যক্তির হৃদয় হিদায়তের জন্য অনুসন্ধিৎসু হয়।
যা হোক, করোনার জন্য নানান মুক্তি আর আয়েশের মধ্য দিয়ে যে 'স্বেচ্ছা গৃহাবস্থান' তা নিয়ে তামাশার কোনও অন্ত নেই ফেসবুকে! অল্পেই এই হা-হুতাশের কালে কেবল ছোট্ট করে, একটুখানি সিরাত।
আহা, উম্মতের জন্য রাসুলের সেই বন্দিত্বের দিনগুলো!
[৩] [৪][৫][৬][৭][৮][৯][১০][১১][১২][১৩][১৪]