শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ২৪ মার্চ, ২০২০, ০৬:৫০ সকাল
আপডেট : ২৪ মার্চ, ২০২০, ০৬:৫০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

করোনা গজব না রহমত?

ডেস্ক রিপোর্ট  : বিপদ-আপদ, রোগ-মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির দুটি রূপ রয়েছে। হযরত ইমাম গাযযালী বলেন, ‘যে বিপদ মানুষকে আল্লাহমুখী করে, সেটি তার জন্য রহমত। আর যে বিপদে মানুষ আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায় কিংবা আল্লাহ থেকে উদাস ও বেভুল অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে, এটি তার জন্য গজব।’ দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও এমন বিপদ, রোগ-মহামারি এসেছে। হযরত ওমর (রা.)-এর যুগে ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ার মহামারিতে গভর্নর আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ শাহাদতবরণ করেন। সাহাবী মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-ও প্লেগ মহামারিতে শহীদ হন। অনেক সাহাবী ও পরবর্তীতে বহু ওলী-আউলিয়া এসবে শাহাদতবরণ করেছেন। তাহলে বিপদকে এককথায় গজব বলা উচিত হবে না। এখানে একই সমস্যা ঈমান ও জীবনবোধের আলোকে দুটি রূপ নিয়ে ধরা দেয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে মহামারিতে মৃত্যুবরণকারীরা শহীদ।’ নবী করিম (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহামারির সময় ধৈর্য্য সহকারে, সওয়াবের আশায় নিজেকে ঘরে রুদ্ধ রাখে, এ ধারণা নিয়ে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন এর বাইরে কোনো কিছুই ঘটবে না। সে ব্যক্তিও শহীদের সাওয়াব পাবে।’ মহামারিতে তার মৃত্যু হোক বা নাই হোক। ফতহুল বারী, শরহে বুখারী ১৯৪/১০।


বর্তমানে কয়েক মাস যাবত সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। প্রায় দুইশত রাষ্ট্র এতে আক্রান্ত। এই লেখা তৈরি করার সময় পর্যন্ত ৩ লক্ষাধিক মানুষ ভাইরাসকবলিত এবং মৃতের সংখ্যাও ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অফিসিয়াল পরিসংখ্যানের বাইরে এর সংখ্যা আরো বেশি হবে। সতর্কতা ও নজরদারী ছাড়া এটি এড়ানোর তেমন কোনো পথ নেই। অবশ্য, এর ভ্যাকসিন বা ওষুধ নিয়ে গবেষণা পাল্লা দিয়ে চলছে। আল্লাহ চাইলে একটি সুরাহা হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি রোগেরই ওষুধ আছে।’ মানুষ এটি খুঁজে বের করতে যতটুকু সময় লাগে। আমরা জানি, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ঈমানদাররা ঈমানের আলোকেই ইতিবাচক চিন্তা করে। মন্দের ভেতরেও তারা ভালো কিছু খুঁজে পায়। আমরা করোনাভাইরাস থেকে গোটা মানব জাতির জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পাওয়া কিছু ভালো দিক নিয়েও আলোচনা করতে চাই। তকদিরে যা আছে, তাতো হবেই, তবে, ঈমানদারের জন্য আল্লাহর কোনো ফায়সালাই ক্ষতিকর হতে পারে না। এটি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এখানে ভীতি কাম্য নয়। কাম্য সতর্কতা ও ঈমান।

এ বিপদমুহূর্তে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত গোটা দুনিয়া বেশ অসহায় হয়ে পড়েছে। সবার মুখেই শোনা যাচ্ছে, প্রার্থনার কথা। আল্লাহর নাম নেওয়ার কথা। সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনার কথা। মানুষ আল্লাহমুখী হচ্ছে। এটি বিপদের একটি বড় ইতিবাচক অর্জন। নাস্তিকতার বিষবাষ্প কিছুটা হলেও স্থিমিত হয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে নাস্তিকতা ছিল একটি ফ্যাশন। ধর্মহীনতা ছিল এক ধরনের স্মার্টনেস। ভাইরাসের বিপদ নামার পর দুনিয়াজুড়ে লোকজন ধর্মমুখী হচ্ছে। নাস্তিকতার তুফান দুর্বল হয়ে আসছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন যা প্রায় বিরল হয়ে গিয়েছিল, ইদানীং তা বিপদের কারণে অনেকটা আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। পড়া বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা যেমন ঘরে, ঠিক তেমনি বাইরে অল্প সময় দিয়ে মা-বাবাও দ্রুত ঘরে ফেরায় তাদের পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা, একসাথে খাওয়া-দাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর খবর নিতে পারতো না। এখন জরুরি অবস্থায় সবাই একে-অপরকে যেভাবে পারে যোগাযোগের মধ্যে রাখছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের জীবনাচার শেয়ার করতো, এখন তারা বাস্তব জগতে বসবাস করছে।


মানুষ স্যোশাল মিডিয়াকে বিনোদন, তথ্য ও সংবাদের জন্যই ব্যবহার করতো। বর্তমানে এতে কোয়ালিটি পরিবর্তন এসেছে। মৃত্যুর স্মরণ, দুনিয়াবিমুখতা, দোয়া-দরুদ, ভালো কাজের চর্চা, ঈমান-আমলের দাওয়াত আদান-প্রদান হচ্ছে। অনর্থক ঘোরাফেরা, চলাচল ও পর্যটন কমে যাওয়ায় প্রকৃতির ওপরও চাপ কমছে। নানা কারণে বৈশ্বিক জলবায়ুর নেতিবাচকতা কমছে, পৃথিবীতে ভালো কাজের একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কোন দেশ কতটা কল্যাণ রাষ্ট্র তা প্রমাণের সুযোগ হয়েছে। নেতারা পারস্পরিক দম্ভ, হানাহানি, হুমকি ও বিদ্বেষ বাদ দিয়ে একে-অপরকে সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছেন। দুনিয়াতে কার্যকরী যুদ্ধও বলতে গেলে থেমে আছে। ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের, চিকিৎসা ও ত্রাণ সামগ্রি বিনিময়ের ভাবনা তৈরি হয়েছে। চীন বিপদ কাটিয়ে ওঠে এখন অন্যদের সহায়তায় নেমেছে। তুরস্ক আমেরিকাকে কিট সরবরাহ করছে। বহু দেশে সরকার জনগণকে ভর্তুকি ও বিশেষ সহায়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, খাদ্য এবং ঘরে থাকা ও স্বাস্থ্যনির্দেশনা মেনে চলার জন্য আলাদা ইনিশিয়েটিভ দিচ্ছে।


বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রতি কিছু দেশ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যে বৈরিতা ও বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছিল তা মানবিক কারণে বিপদের সময় মানুষ ভুলে গেছে। পরস্পরের শত্রুরা মহাদুর্যোগের সময় একসাথে শান্তিতে বসবাস করতে শিখে। আমেরিকায় একটি জুমার জামাতের পেছনে নারী মুসল্লিদের সাথে অমুসলিম নারী ও শিশুদের এমনিতেই রুকু-সিজদা করতে দেখা গেছে। ইউরোপের রাজপথে মানুষ আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিচ্ছে। স্পেনে সন্ধ্যায় মাগরিবের সময় মহল্লায় মহল্লায় বিপদমুক্তির জন্য আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। করোনার গোটা সময়টি ধরে রাশিয়ার প্রধান মসজিদে ২৪ ঘণ্টা একটানা কোরআন খতম চলছে। চীনে জুমার নামাজে অমুসলিমরাও বিপুল সংখ্যায় এসে যোগ দিয়ে মুনাজাতে শরিক হয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে লাউড স্পিকারে আজানের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভারতে ৩০ কোটি মানুষ সুনামির মতোই করোনার হুমকির মুখে। সেখানেও হয়তো কৃত্রিম উপায়ে প্রজ্জ্বলিত সাম্প্রদায়িকতার আগুন নিভে যাবে। বিপদ মানুষকে মানবিক হতে শেখায়। আল্লাহর কাছে টানে। প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। যদি আসলেই এমন হয়, তাহলে বিপদ গজব নয়, রহমত।


বাংলাদেশে সার্বিক প্রস্তুতি দুর্বল। অবশ্য, দ্রুত সিরিয়াস হলে প্রতিরোধ, চিকিৎসা, সচেতনতা সবই করা সম্ভব। এখানে লোকচুরি কিংবা কূটকৌশলের আশ্রয় না নিয়ে পরিস্থিতি সবাইকে নিয়ে সামাল দেয়া দরকার। গোপন রাখলে বিপদ কমবে না। সর্বস্তরে তওবা, ইস্তেগফার করতে হবে। অন্যায়, দুর্নীতি ও হারাম উপায়ে অর্জিত সম্পদ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। এই মুসিবতকে উপলব্ধি না করে বড় বড় কথা, পাল্টা চ্যালেঞ্জ কিংবা ঈমান বিধ্বংসী ফালতু কথাবার্তা কমাতে হবে। দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে শেষ বিচারের দিন মহান আল্লাহর দরবারে জবাব দেয়ার চিন্তাটি এখনই তাজা করার মোক্ষম সময়। সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার জন্যই হয়তো আল্লাহ এই বিপদটি আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যাদের হাতে দেশের সব টাকা জমা হয়েছে, তারা জনগণের সেবা করার এই সুযোগটি হেলায় হারাবেন না। জানা নেই, মৃত্যু কখন কাকে স্পর্শ করে। হালাল টাকা-পয়সা কুক্ষিগত করে না রেখে বিপন্ন মানুষের জন্য ব্যয় করতে হবে। নিজে একা খেলে হবে না। চারপাশের মানুষকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করতে হবে। মানবতার পরীক্ষার দেয়ার এটাই সুযোগ। সামনে রমজান। প্রস্তুতি নিতে হবে, আল্লাহর রহমত, নাজাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের। যদি করোনাভাইরাস বাংলাদেশে তার ভয়াল রূপ নিয়ে আল্লাহ না করুন, প্রকাশিত হয়, তাহলে লাখো মানুষের জীবনহানী, কোটি মানুষের ভয়াবহ কষ্টের আশঙ্কা আছে। এই ক্ষেত্রে দোয়া, কান্নাকাটি, নামাজ-বন্দেগি, তওবা এবং অধিক নেক আমলের বিকল্প নেই। লক্ষ করা গেছে যে, বিপদের এই সুযোগে নাস্তিক্যবাদী কিছু মানবভাইরাস তাদের ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম চালিয়েই যাচ্ছে। প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, সতর্কতা ইত্যাদির ওপর জোর না দিয়ে এবং বিনোদন, কেনাকাটা, অহেতুক জনসমাগম নিয়ে কথা না বলে এরা কেবল মসজিদ ও দোয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। লাশ দাফনের বদলে পুড়িয়ে ফেলার প্রস্তাব দিচ্ছে। সমস্যা গভীর হওয়ার আগেই জানাজা বন্ধের প্রস্তাব দিচ্ছে। এটি জনমনে দুঃখ ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এসব উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার বন্ধ হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মসজিদ বন্ধ হবে না, বরং অসুস্থ ব্যক্তিরা মসজিদে আসবেন না।’ মানুষ জীবনযাত্রা পুরো থেমে গেলে কিংবা আল্লাহ না করুন মহামারিতে সবকিছু অটো লকডাউন হয়ে গেলেও একজন মুসলমান বেঁচে থাকা পর্যন্ত আজান, নামাজ ও মসজিদ বন্ধের কথা ভাবা যায় না। সবকিছু খোলা রেখে শুধু মসজিদের দিকে আঙুল তোলা নিশ্চয়ই কোনো ভালো মানুষের কাজ নয়। জরুরি অবস্থার সব বিধানই শরিয়ত দিয়ে রেখেছে। প্রয়োজনে শরীয়তের আলোকে মসজিদে ব্যবস্থাপনাও চলবে। এ নিয়ে ধর্মহীন নাস্তিকদের অধিক মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

একটি কথা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান এবং দেশ ও জাতির প্রতি ক্ষেত্রে যারা দায়িত্বশীল সবাইকে এখনই বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ ধর্মবিশ্বাসী শান্তিপ্রিয় সাহসী মানুষের দেশ। যত বিপদই আসুক মানুষ আল্লাহমুখী হয়ে মসজিদে গিয়ে, দোয়া, দান-খয়রাত, নামাজ-বন্দেগির মাধ্যমে সমস্যা কাটিয়ে উঠার পথ বের করে। এ মনোভাবটি দায়িত্বশীলরা যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল। কৃত্রিম উপায়ে জনগণের মনোভাব বদলানো যাবে না। এই ধর্মপ্রাণ অনুভূতিটি সরকার যদি মূল্যায়ন না করে তাহলে এখানে উগ্রপন্থা নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করবে। এই জন্য ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় নেতৃত্ব তথা আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং ধর্মীয় সামাজিক নেতৃত্বের সাথে রাষ্ট্র ও সরকারকে গভীর সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। বিশেষ করে, এই বিপদের সময়টিতে মানুষের মনোভাব বিশ্লেষণ করে সঠিক দায়িত্ব পালন করার বিকল্প নেই। মানুষকে একথাটি বোঝাতে হবে, মহামারি যত না গজব, মানুষের বিশ্বাস ও আচরণের ফলে তা এর চেয়ে বেশি রহমত হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়ে থাকে।

সূত্র- ইনকিলাব

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়