শহীদুল্লাহ ফরায়জী : করোনা ভাইরাস সারা বিশ্ব স্তব্ধ করে দিয়েছে। দেশ থেকে দেশ, মানুষ থেকে মানুষ, সমাজ থেকে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অদৃশ্য শক্তি প্রত্যেক মানুষের নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে। পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে মৃত্যু মিছিল। ১৮৩ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যু সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। করোনার থাবায় লন্ডভন্ড শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো! এ সঙ্কট নজিরবিহীন-এ সঙ্কট বিশ্বব্যাপী।
বিশ্ব এখন আতঙ্কিত জনপদ। লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করেও জীবন সুরক্ষা দেয়া যাচ্ছে না-অযত্নে লাশ পড়ে আছে মর্গে, দাফনের লোক নেই, শেষ কৃত্যের অনুষ্ঠান নেই।
করোনা ভাইরাসের মহামারিতে বিশ্ব অবরুদ্ধ। এ রোগ প্রতিরোধে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণাসহ সারা বিশ্ব বিরল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারিতে রূপান্তর হয়ে পৃথিবীর সবকিছু অচল করে ফেলেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, আমরা আজ এমন এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, যখন সাধারণ কোন কৌশল কাজে আসবে না।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ এবং ১১ জানুয়ারি প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। ৩১ জানুয়ারি চীনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার দাঁড়ায়। সেই সময় রাশিয়া, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় মানুষ। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই চীনের বাইরে ফিলিপাইন, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু হয় এবং এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ৮ মার্চ বাংলাদেশে ৩ জন আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে। গত তিন মাস ধরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরও, বৈশ্বিক মহামারি জানার পরও, দীর্ঘ সময় পেয়েও বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংক্রমিত দেশগুলো থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ প্রবাসী দেশে প্রবেশ করেছে তাদের কোন নির্দেশনা ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে না রাখার সিদ্ধান্ত ছিলো আত্মাঘাতী। এ পর্যন্ত আক্রান্তদের সবাই বিদেশ ফেরত ও তাদের সংস্পর্শে আসা স্বজন। আশংকা হচ্ছে আগামী দু এক সপ্তাহে বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাপী এতো ভয়াবহ সংকট, এতো আতঙ্ক, এতো প্রাণহানীর পরও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সেই সম্পর্কে উদাসীন। আমরা যে মানবজাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। বৈশ্বিক চেতনার সাথে আমরা সম্পৃক্ত হতে পারিনি-বৈশ্বিক চেতনা আমাদেরকে আলোকিত করতে পারেনি। বরং তাদের বেদনায় আমাদের উল্লাস, মানুষের পর্যায় থেকে আমাদের নিচে নামিয়ে ফেলেছে-যা সমগ্র মানবতার অবমাননা। এ ধরণের কর্মকাণ্ডের জন্য বৈশ্বিক আত্মা আমাদের অভিশাপ দেবে। এতো বড় বিপর্যয়ে আমাদের চৈতন্যের জাগরণ হলো না।
মৃত্যুর সংখ্যা যখন ১১ হাজার ২২৬ জন, আক্রান্ত যখন ২ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮০ জন, মুমূর্ষ রোগীর জন্য যখন সাধারণ বিছানাও মিলছেনা, যখন মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ হচ্ছে, শ্রীলংকায় যখন পার্লামেন্ট নির্বাচন স্থগিত করেছে তখন বাংলাদেশে উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়ে আর কোন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজ আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি।
সংক্রমণ বাড়লে পরিস্থিতি কী হতে পারে-বিশ্ব অর্থনীতির ভয়াবহ সঙ্কট, ওষুধ ও খাদ্যের আভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ে স্পল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার কোন প্রয়োজন পড়েনি বাংলাদেশে। সমগ্র ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ করোনার ভয়াবহ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষকে বাঁচানোর জন্যে নানা ধরণের সহায়তামুলক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এসব প্রস্তুতির প্রয়োজন উপলব্ধি করছেনা সংশ্লিষ্টরা। আমরা ন্যায় ও নীতি বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি। মানবিক নৈতিক রাষ্ট্র ও ন্যায়সংগত শাসন বিলোপ করে দিয়েছি। এখন করোনা করুণা করা ছাড়া আমাদের আর আস্থার জায়গা নেই। বিশ্ব বিখ্যাত জাঁ জ্যাক রুশো বলেছেন ‘আমি তোমাদের সঙ্গে এমন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে চাই যা তোমাদের জন্য নিয়তই ক্ষতিকর ও আমার জন্য সর্বক্ষণই মঙ্গলজনক এবং এ সন্ধি আমি যতক্ষণ চাই ততক্ষণই তোমার আমার মধ্যে বলবৎ থাকবে’। সরকার ও আমাদের মাঝে এই সন্ধি চুক্তিই কার্যকর আছে। যা আমাদের নিয়তই ক্ষতি করবে আর সর্বক্ষণই সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
লেখক: গীতিকবি
[email protected]
সুত্র- মানবজমিন
আপনার মতামত লিখুন :