শিরোনাম
◈ গাজীপুরে হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু  ◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সেই সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও)

প্রকাশিত : ১০ মার্চ, ২০২০, ০১:৩৪ রাত
আপডেট : ১০ মার্চ, ২০২০, ০১:৩৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সুনামগঞ্জে হাওর ও নদী ঝুঁকিতেঃ প্রশাসন নির্বিকার কেন?

দীপক চৌধুরী : হাওরাঞ্চলে ফসলডুবি রোধ করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিলেও নানাত্রুটি ও অনিয়মের কারণে এর বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। গরু যাতে ফসল না খেতে পারে এজন্য বেড়া দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সেই ‘বেড়া’ই যদি ফসল খেয়ে ফেলে তাহলে কৃষকদের কিছুই করা থাকে না। সুনামগঞ্জের জন্য এটি প্রযোজ্য যেন। এ জেলায় ধান-মাছের হাহাকার এখন। বৈশাখেও কৃষকরা ঘরে ধান তুলতে পারবেন কিনা এটা নিয়ে শঙ্কায় তারা। শুধু ধান নয়, সেখানে এবছর মাছও নেই। মৎস্যজীবীরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, পোনা নিধনের পরিনতি। পোনা শিকারিদের কারণে নদী-বিলে মাছ নেই। নদীতে বা বিলে মাছ না পেলে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন এ দুশ্চিন্তা তাদের। কারণ, মাছের পোনা অবাধে নিধন করেছে চোরা শিকারিরা। অথচ মাছ-ধান দুটির জন্যই সুনামগঞ্জ বিখ্যাত ছিল। আরো বিস্ময়ের ব্যপার হাওর এখন তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। বর্ষায় থৈ থৈ করা পানি আর দেখা যায় না। পিআইসির বাঁধ দেওয়ার নামে ‘রাবণরাজত্ব’ চলছে সেখানে। বর্ষায় থাকবে না হাওরের সৌন্দর্য আর বৈশাখে গৃহস্তের ঘরে উঠবে না ধান। এসব দেখার কেউ নেই। দিনমজুরেরা কাজ পাচ্ছে না, বেকারত্ব এসেছে তাদের জীবনে। অথচ এই সময়টাতে তাদের একদণ্ড ফুসরৎ ছিল না। শ্রমিকের কাজ এখন করছে মেশিন।

ধান আর মাছের জন্য বিখ্যাত হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল সুনামগঞ্জ। এখন এর উল্টোটা ঘটছে। নানারকম অনিয়ম আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের কারণে সুনামগঞ্জের হাওর তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। প্রায় প্রতিবছরই ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে সর্বগ্রাসী বন্যার পানি হাওরে ঢুকে পড়ে। ‘ধানের খনি’ জলের অতলে হারিয়ে যায়। এক ফসলি হাওর হাহাকারে ভরে যায়। লক্ষণীয়, যতবারই ফসলডুবি হয়, ততবারই এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, বাঁধে নির্মাণ ত্রুটি কিংবা সময়মতো তা সংস্কার না করা। ২০১৭ সালের ফসলডুবির পর থেকে এ সরকার হাওর রক্ষায় বিশেষ তৎপরতা দেখিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে বন্যাক্রান্ত ভাটিঅঞ্চল শাল্লা গিয়ে সমাবেশ করেছিলেন। কৃষকদের দুঃখ নিজের চোখে দেখে এসেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন এখানের কৃষকরা আর কষ্ট পাবে না। তার অংশ হিসেবে প্রতিবছরের মতো এ বছরও হাওরাঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। আশঙ্কার কথা, সরকারের তথা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বে কিছু কর্মকর্তার গাফিলতিতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় নিজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করায় কৃষক সম্প্রদায় ভীষণ উপকৃত হয়। কিন্তু সুনামগঞ্জে তা দেখা যাচ্ছে না। যদিও অনেকেই জানি, নিজের সততার পাশাপাশি এনামুল হক শামীম যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পিছপা না হওয়ায় গরিব কৃষকরাও উপকার হচ্ছে। খবর হলো, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে সীমাহীন অনিয়ম হচ্ছেই। দিরাই উপজেলা থেকে বিভিন্ন কৃষক মোবাইল ফোনে নানারকম দুর্নীতি অনিয়মের কথা জানিয়ে আক্ষেপ করেন এই বলে, যে ব্যক্তির এক ছিটে জমিনও নেই হাওরে সেই ব্যক্তিটি পিআইসি পেয়ে গেল কীভাবে? কৃষকের কষ্ট পিআইসিওয়ালারা বুঝবে কীভাবে? উপজেলার একশ্রেণির টাউট-বাটপারেরা ঘুষের বিনিময়ে পিআইসির কাজ বিক্রি করেছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ কৃষকদের। আরো শোনা গেল, যে জায়গা থেকে মাটি কেটে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে নদীর পাড় ভেঙ্গে আবার তা নদীতেই পড়বে। নদী ভরাট হবে। নাব্যতা কমবে। নদী খননের নামে আরেকদফা লুটপাট হবে। ধলগ্রামের ফুটবল খেলার মাঠ কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে বাঁধের জন্য। উজানধল খেলার মাঠ কেটে মাটি নেওয়া হয় কীভাবে? যেন পরিচ্ছন্ন মাঠকে ধর্ষণ করা হয়েছে। প্রশাসন নির্বিকার কেন? হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ ব্যক্তির ফসলী জমি কেটে রাতের অন্ধকারে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় এমন অন্যায় সম্ভব হতো। এমন জুলুম অতীতে হয়েছে কিন্তু এখন হবে কেন? এই অনিয়ম-নৈরাজ্য দেখার কী কেউ নেই- এ প্রশ্ন কৃষকদের।

এবারও নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করার কথা ছিল, কিন্তু শেষ হয়নি। কাজের গড় অগ্রগতি নাকি মাত্র ৫৮ শতাংশ। অথচ জমির বোরো ফসল এসব বাঁধের ওপরই নির্ভর করে। সেখানকার বাঁধ মেরামতে এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। বরাদ্দ থাকার পরও কাজ শেষ না হওয়ায় কর্মকর্তারা যেটি দেখাতে পারেন তার নাম অজুহাত। গত বছরও পানি সরতে সময় লেগেছে বলে কাজ ঠিক সময়ে শেষ করা যায়নি। মনে রাখা দরকার, হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হতো। ২০১৭ সালের বন্যায় হাওরে ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঠিকাদারি পদ্ধতি বাতিল করে পিআইসির মাধ্যমে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের একশ্রেণির আওয়ামী লীগের নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে এখন অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। প্রশাসন যদি ব্যর্থ হন তাহলে তা হতাশা ছাড়া আর কী এনে দিতে পারে?
সুনামগঞ্জে সেই ঐতিহ্য নেই, আছে হাহাকার অনিশ্চয়তা। ধান-নদী-মাছ সুনামগঞ্জে বিখ্যাত ছিল একসময়। কৃষির ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষক যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে দিরাই জনসমাবেশে এসে সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার কৃষকদের একমাত্র গৌরবের ধন বোরো ফসলের কথা জেনেছিলেন। এজন্য সারাদেশের মতো সেখানেও ঋণ বণ্টন; সার সংগ্রহ; ধানের বীজ বণ্টন; গভীর নলকূপ - অগভীর নলকূপ স্থাপনের পরামর্শ ও কমসূচি দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি জলাশয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায় সেই চিন্তাও ছিল তাঁর সরকারের। সম্ভবত এ কারণেই মুক্ত জলাশয়ের স্বাদু মাছের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সেটা নেই আজ।

আমরা সবাই জানি, মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য গড়ে তোলা হয় অভয়াশ্রম। কিন্তু সেই অভয়াশ্রমই যদি মাছ শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা না পায়, তা হলে মাছ রক্ষা হবে কীভাবে। বিশেষ করে গত এপ্রিল-মে-জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে সুনামগঞ্জের সেইসব নদী-হাওরে নির্বিঘ্নে পোনা নিধন চলেছে। অভয়াশ্রমে সব ধরনের জাল ফেলা নিষেধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু সুনামগঞ্জের জন্য যেন সেই আইন নেই। বিভিন্ন নদী ও হাওরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অভয়াশ্রমের বিভিন্ন স্থানে বেড়া দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছেন শিকারিরা। মৎস্যজীবীরা এ অনিয়মের বিচার চেয়েছেন। অথচ বিচার পাননি। ফলে জেলেরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছেন এসব অনিয়ম। মিঠে পানির মাছের ওপর চলেছে অত্যাচার। ডিমওয়ালা মাছ হত্যা করা হয়েছে। দেশি মাছের পোনা নিধন করা হয়েছে। নিষিদ্ধ জাল ফেলেছে শিকারিরা। ৫০০ থেকে ১০০০ মিটার দীর্ঘ এসব জাল। বাঁশের সঙ্গে অবৈধ কারেন্ট জাল যুক্ত করে ছোট-বড় সব ধরনের মাছ ধরেছে চোরা শিকারিরা। এতে নদীতে-বিলে-হাওরে পোনা নিধন করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বা জেলা প্রশাসন কোনো বাধা দেয়নি, কোনো উদ্যোগ ও নেওয়া হয়নি। এর ভয়াবহ পরিনতি এ মওসুমে দেখা যাচ্ছে। যারা সরকারকে লক্ষ- কোটি টাকা রাজস্ব দিয়ে জলমহাল নিয়েছেন তারা এখন অসহায়। এই পৌস-মাঘ বা ফাগুনমাসে নদীতে মাছ নেই, বিলে-হাওরে মাছ নেই। মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আছে,শুধু হাহাকার। সমিতি করে থাকা প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বিচার পাবেন কোথায়? দিরাইয়ের মাছরাঙা মৎস্যজীবী সমিতির সম্পাদক- সভাপতি জানালেন, ‘জঙ্গী-প্রতারক-সন্ত্রাসীরা নব্য আওয়ামী লীগার সাজছে এখন। আমরা তো দিন আনি দিন খাই। যাদের বিরুদ্ধে মাছ লুণ্ঠন, জলাশয় লুটপাট, চুরি-দস্যুতা, অগ্নিসংযোগ-সন্ত্রাসের অভিযোগে মামলা রয়েছে সেসব জেলেনামধারী দুর্নীতিবাজেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা দেশের উন্নয়ন চায় না, নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত।’

কিছু সন্ত্রাসী জেলে ও মাছ শিকারির কারণে নদীতে গাছ-বাঁশ ফেলে নির্মাণ করা অভয়াশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এখন। জেলেরাই স্বীকার করেন, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। গত বছরের জুলাই মাসে মাছবিষয়ক তিনটি সংস্থার প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পুঁটি, ট্যাংরা, মাগুর, পলি, বোয়াল, রুই,আইড়সহ ৯১ প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। দূষণ ও দখলের কারণে নদী, খালসহ বিভিন্ন জলাভূমিতে দেশি মাছের উৎপাদন কমছে। দেশে এখন দেশি ছোট মাছ নেই। তাদের সংখ্যা কমে গেছে । এ ছাড়া পলি পড়ে নদ-নদী ভরাট হওয়ার কারণেও মাছের বিচরণ কমে আসছে। এর ফলে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এটা নদী, হাওর অঞ্চলের জন্য অর্থাৎ দেশের জন্য অশুভ লক্ষণ। কারণ, আমাদের আমিষের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হয় মাছ থেকে। গ্রামীণ মৎস্যজীবী মানুষের আয়- রোজগারের একটি বড় উৎস হচ্ছে মাছ। মাছ রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো তৎপরতা থাকবে না কেন? আমাদের মিঠেপানির কোনো মাছই বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে নাÑ এ চিন্তা এবং পরিকল্পনা থাকা দরকার। যাতে কেউ মাছ শিকার করতে না পারে, সে জন্য মৎস্য অধিদপ্তরকে নজরদারি বাড়াতে হবে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যারা মাছ শিকার করছে,তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, উপ-সম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়