শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের রাজনীতির অবনতি দুঃখজনক: পিটার হাস ◈ সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বাড়লো ১০ টাকা  ◈ নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের আহবান শিল্পমন্ত্রীর  ◈ প্রচণ্ড গরম থেকেই ঘটতে পারে মানবদেহের নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি ◈ অবশেষে রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি  ◈ ইসরায়েল পাল্টা হামলা করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান: উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ মিয়ানমারের আরও ১০ সেনা সদস্য বিজিবির আশ্রয়ে ◈ সয়াবিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ◈ কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকি, আইনের শাসনে জীবনযাপন করি: ড. ইউনূস

প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৭:০৪ সকাল
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৭:০৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নয়ন মেলিয়া হঠাৎ দেখি ওয়েস্টিনে পাপিয়া

রুমিন ফারহানা : গত ১১ বছর দেশে কোনো অনাচার-অবিচার দুর্নীতি-লুটপাট কিচ্ছু হয়নি। অন্তত সরকারদলীয় নেতাকর্মী-সমর্থক, আর সুবিধাভোগীদের কথায় তাই মনে হতো আমাদের। চারদিকে বড় বড় ফ্লাইওভার, ঢাকা শহর এফোঁড় ওফোঁড় করে মেট্রোরেল বানানোর উদ্যোগ, বিশাল অঙ্কের প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসব নিয়ে সরকারদলীয় বক্তারা যখন টকশোর টেবিল, ঘরোয়া সভা কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গলা ফাটান, তখন মনেই হয় না, দেশে কোনো সমস্যা আছে। বিপক্ষ বা বিরোধী দল দুর্নীতির কথা বলার চেষ্টা করলে সরকারি দলের সদস্যরা তেড়ে উঠে মনে করিয়ে দেন খুব দ্রুত উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গেলে ‘কিছু’ দুর্নীতি নাকি হয়েই থাকে। সেই ‘কিছু’ দুর্নীতির নমুনা গত কয়েক মাসে মাত্র কয়েক বার বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আমরা দেখলাম শুদ্ধি অভিযানের নামে।

ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির খবরে তাদের বহিষ্কারের পরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ছাত্রলীগ ধরেছি, এখন যুবলীগ ধরবো। ফৌজদারি অপরাধে মামলা না করে কেবলমাত্র বহিষ্কার, পদত্যাগ, নতুন পদ বা পদোন্নতি না দেয়া, বদলি, যথেষ্ট শাস্তি হতে পারে কিনা সে বিতর্ক সাধারণ মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়ে শুধু এটুকুই বলা যায় এতে এ ধরনের অপরাধ দমন তো দূরে থাকুক, অপরাধীদের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দেয়া হয়। সাধারণভাবে যার অর্থ দাঁড়ায় ক্ষমতায় এবং পদে থাকলে যে কোনো অপরাধ করেই পার পাওয়া যাবে, জেল জরিমানা দূরেই থাক, শাস্তি হবে বড়জোর কিছুদিন পদ থেকে দূরে থাকা।

মানুষ মনে করে না, ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদককে সরিয়েই তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী নানামুখী অপকর্মের ইতি টানা গেছে। সামাজিক গণমাধ্যম, যেখানে সাধারণ মানুষ যা চিন্তা করে সেটাই ফুটে উঠে সেখানে খুব স্পষ্টভাবেই এগুলোকে আইওয়াশের চেয়ে বেশি কিছু বলা হয়নি।

ছাত্রলীগের কাহিনী উন্মোচিত হতে না হতেই যুবলীগের ওমর ফারুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে তীব্র গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কি এতদিন আঙ্গুল চুষছিলেন?’ কথার ভেতর যুক্তি আছে। একজন সম্রাট, খালেদ, সেলিম প্রধান বা জি কে শামীম সরকারদলীয় বড় নেতা, মন্ত্রী-এমপি, প্রশাসন কারো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই ভিখারি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, একথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

বহুদিন ‘আঙ্গুল চোষা’র পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে হঠাৎ করেই মানুষ একদিন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলো আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বাড়ি ঘাঁটলে সিন্দুকে কয়েকশ’ কোটি টাকা পাওয়া যায়, তেমনি হঠাৎ করেই এক কাকডাকা ভোরেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আবিষ্কার করলো ঢাকার বুকে পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনে গত তিন মাসে প্রায় তিন কোটি টাকা মদ, নারীর আর মনোরঞ্জনের পেছনে ব্যয় করেছেন। ঘুমিয়ে ছিলেন তারা এতদিন, নয়ন মেলে দেখেন ওয়েস্টিনে পাপিয়া। তাই আর দেরি না করে করিৎকর্মা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাবের তথ্য মতে, তিনি গ্রাম থেকে মেয়েদের এনে রাঘব-বোয়ালদের মনোরঞ্জনে ব্যবহার করে সেটার ভিডিও করতেন। তারপর সেটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন সেই সব রাঘব-বোয়ালদের।

কথিত আছে ব্ল্যাকমেইল করতে করতে তিনি তার ‘সীমা’ ছাড়িয়ে একটু বেশিই ওপরে উড়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতে, ‘সরকারের সায়ে’ মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে তাকে। শুদ্ধি অভিযান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্ন করলে তারা অবলীলায় বলেন, এই অভিযান নাকি চলমান আছে। অথচ সম্রাট, খালেদ, শামীম, সেলিম আর হালে পাপিয়া ছাড়া তো শুদ্ধি অভিযানের নমুনা দেখলাম না। এভাবে চেরি পিকিং এর মতো সুবিধা অনুযায়ী হঠাৎ হঠাৎ সাধু সেজে একে-তাকে ধরার মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রোলের জোগান দেয়া যাবে হয়তো, এর বেশি কিছু না। এসব লোক দেখানো নাটক দিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা দুর্নীতি দূর করা তো দূরেই থাকুক কোনোভাবে কমানোও সম্ভব না।

অতি আলোচিত এই ঘটনাগুলো আর কিছু না হোক কয়কটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। ১) আষ্টেপৃষ্ঠে অপকর্ম আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছাত্রলীগকে পথে আনতে হঠাৎ কেন শীর্ষ পদের দু’জনকে সরানো হলো?

২) তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন প্রচলিত আইনে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না? ৩) এই দুই শীর্ষ পদধারী ছাড়া ছাত্রলীগের আর সবাই কি সাধু?

৪) ছাত্রলীগের দুই শীর্ষপদের পরে হঠাৎ করে যুবলীগের দুই-তিনজন পাতি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণ কী?

৫) আওয়ামী লীগে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পাতি নেতা যদি ফুটপাথ থেকে উঠে এসে হাজার কোটি টাকা বানাতে পারে তাহলে গত ১১ বছরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা নেতারা কী পরিমাণ অর্থ বানিয়েছেন?

৬) রাস্তা থেকে উঠে হঠাৎ করে একা হাজার কোটি টাকা বানানো সম্ভব না। যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে একেকজন সম্রাট শামীম বা পাপিয়া তৈরি করেন তাদের কেন কখনো সামনে আনা হয় না?

৭) ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং হালে যুব মহিলা লীগের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং সুদৃষ্টির প্রয়োজন হলো। তার মানে কি এই ওনার নির্দেশ কিংবা ইচ্ছা ছাড়া এদেশে কোনো অপরাধী সাজা পাবে না?

৮) বনেদি পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছেলের হাত থেকে রাজনীতি এখন চলে গেছে ড্রাইভার, হকার, ফেরিওয়ালা, মোটর মেকানিক যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরেই থাকুক ন্যূনতম নৈতিক মূল্যবোধই তৈরি হয়নি তাদের হাতে। এসব মানুষ রাজনীতিতে গিয়ে একেকজন সম্রাট, শামীম হয়েই কি ওঠার কথা ছিল না?

মাঝে মাঝে ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা যুব মহিলালীগ এর কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়, আর সরকারিদলীয় লোকজন এবং অনেক ‘নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী’ গগনবিদারী আওয়াজ তোলেন শুদ্ধি অভিযান চলছে বলে। এই শুদ্ধি অভিযান নাকি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে ফেলবে। অথচ যে কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একেবারে সাধারণ মানুষের ট্রোল দেখলেই বুঝতে পারবে সরকারের এই প্রপাগান্ডা একেবারেই ব্যর্থ। সরকার কি এটা জানে না, বোঝে না? ওদিকে শুদ্ধি অভিযান বলে কোনো কিছু মানুষকে তো গেলানো গেল?ই না, কিন্তু এই ঘটনাগুলো সরকারের সীমাহীন লুটপাটের কিছু অকাট্য প্রমাণ তুলে দিল মানুষের হাতে। আপাতদৃষ্টিতে এটাতো সরকারের জন্য ক্ষতিকর হলো। সরকার কি এতোই বোকা, যে তারা এমন করছে? আসলে এই দেশের সাধারণ জনগণ কী ভাবছে সরকারকে নিয়ে, সেটা সরকারের কাছে ন্যূনতম মূল্য রাখে না বহু আগে থেকেই।

ছাত্রলীগের দুই অস্ত্রধারীকে সরানোর ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে তাদের সংঘাত আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছিল। যুবলীগের যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নাকি নেয়া হয়েছে স্বাধীনভাবে অনেক উঁচুতে উড়তে থাকা সরকারি দলের এক খুব প্রভাবশালী সদস্যকে মাটিতে নামিয়ে আনতে। এখন পাপিয়ার ক্ষেত্রেও শোনা যাচ্ছে একই কথা। অর্থাৎ যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি দলের অভ্যন্তরে যে কাঠামোটা এই লুটপাটের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে কোনো সংঘাত সহ্য করা হচ্ছে না। যে-ই সেটাকে চ্যালেঞ্জ করে আলাদা কাঠামো তৈরি করতে চাইবে তাকেই এরকম মাশুল দিতে হবে। আর রীতিমতো মিডিয়া ডেকে সবকিছু প্রকাশ করা হচ্ছে জনগণের জন্য না, ওটা দেখানো হচ্ছে দলের অন্য সদস্যদের যারা মূল কাঠামোর বাইরে গিয়ে অনেক বেশি উঁচুতে উড়ছে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য। লেখক: সংসদ সদস্য, বিএনপি

সূত্র: দৈনিক মানবজমিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়