শিরোনাম
◈ অবশেষে মার্কিন সিনেটে সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস ◈ কক্সবাজারে ঈদ স্পেশাল ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল চলাচল বন্ধ ◈ ইউক্রেনকে এবার ব্রিটেননের ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ◈ থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ◈ জিবুতি উপকূলে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে ৩৩ জনের মৃত্যু ◈ লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, চাপ পড়ছে গ্রামে ◈ এফডিসিতে মারামারির ঘটনায় ডিপজল-মিশার দুঃখ প্রকাশ ◈ প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ◈ প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাত চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন নির্বাচিত ◈ বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিত : ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৮:৩১ সকাল
আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০৮:৩১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রাজনীতির মজ্জাগত পুরুষতন্ত্র

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি নির্বাচনে মোহাম্মদপুরের একটি এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন ডেইজী সারওয়ার। নির্বাচনে জিততে পারেননি। তিনি নিজ দলেরই আরেক প্রার্থীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বলতে গেলে নির্বাচনী মাঠেই থাকতে পারেননি। অবধারিতভাবেই পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনের সময়টায় যেমন, নির্বাচন পরবর্তী সময়েও তেমনভাবে তিনি আলোচনায় আছেন। তার প্রচারে ব্যবহৃত নির্বাচনী গান ও সমর্থকদের নৃত্য ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলো। প্যারোডি গান সবাই করেছে, কিন্তু কারও গান নিয়ে এতোটা ট্রল হয়নি যতোটা হয়েছে ডেইজী সারওয়ারকে নিয়ে। তিনি হেরে যাওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে ট্রল যেন আরও বেড়েছে। ডেইজী আগেরবার নারী সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। এবার ছিলেন সাধারণ ওয়ার্ডে পুরুষদের বিরুদ্ধে নারী প্রার্থী। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। নির্বাচনে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক পুরুষতন্ত্রে তার এই সাহস ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। তারাই ট্রলের উদ্যোক্তা এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ট্রল করছেন নারীরাও। ওই নারীদের ভেতর সুপ্ত পুরুষতন্ত্র কতোখানি জায়গা দখল করে আছে সেটি তারা নিজেরা অনুধাবনও হয়তো করতে পারছেন না।

অথচ নগর সরকার হোক বা সুশাসনের অঙ্গীকার হোক, যেকোনো উছিলায় এই নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীদের মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের একটি ছিলো নারীর ক্ষমতায়ন। টেলিভিশন টকশো, পত্রিকার সম্পাদকীয়, সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণে কতো কথাই না হলো এ নিয়ে। ব্যাপক আলোচনা হয়েছেÑ কীভাবে এই শহরকে নারীবান্ধব করা যায়, নারীদের কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে আরও বেশি করে আনা যায়।
নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টা কী? খুব সহজ করে বললে, নারী-পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য। আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা ঠিক এখানেই। অভ্রান্ত নারীবাদ পুরুষের কথাও বলবে। কারণ নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়েই মানুষের সভ্যতা। কিন্তু লিঙ্গ রাজনীতি নারীকে সরিয়ে রাখতে চায় সব কিছু থেকে। নানাবিধ প্রচেষ্টায় নারীরা স্বাধীনতার দিক দিয়ে হয়তো কিছুটা এগিয়েছে। কিন্তু এটিই যথেষ্ট নয়। পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ (সে নারী বা পুরুষ উভয়ই হতে পারে) নারীকে শুধুই প্রজননের জরায়ুযন্ত্র হিসেবে দেখছে। আর তা দেখেছে বলেই পুরুষতন্ত্র মনে করে সেই প্রজনন যন্ত্রের উপর তার প্রভুত্বের অধিকার আছে। ডেইজী সারওয়ারের ঘটনা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় আমাদের রাজনীতিতে এমন কোনো সক্ষমতার অভাব যা নারীদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে? আমদের নেতানেত্রীরা প্রায়ই বলেন, নারীরা এখন আগের চেয়ে এগিয়ে আসছে, থানায় অভিযোগ করছে বেশি। আর সে কারণেই নারী নির্যাতন ও সহিংসতার খবর বেশি করে গণমাধ্যমে আসছে। এগুলো নিখাদ রাজনৈতিক বক্তব্য। আমরা চাই নারী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হবে এবং তারা লজ্জা রেখে, ভয়ে লুকিয়ে না থেকে প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিচার চাইবে।

আমাদের রাজনীতি কতোটা অরাজনীতি অন্তত নারীর রাজনীতি ও ক্ষমতায়ন প্রশ্নে, সেটা বোঝা যায় ডেইজী সারওয়ার ইস্যুতে। কিন্তু তার চাইতেও বড় অভিযোগও আছে। পুরোটাই সঠিক রাজনৈতিকবোধের অভাব। ক্ষমতার বণ্টনই রাজনীতি। সুস্থ রাজনীতি মানুষে মানুষে ক্ষমতার সমতা আনে। খারাপ রাজনীতি বৈষম্য তৈরি করে, বৈষম্য বজায় রাখে। নারীর সক্ষমতা, নারীর আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার সব চাইতে সহজ উপায়ের একটি হলো সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করা। এটি প্রকারান্তরে যৌন সহিংসতা। একটিই বার্তাÑ তুমি অনেক কিছু করতে পারো, বেশি রোজগার করতে পারো, ভোটে দাঁড়াতে পারো, পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী তোমাকে তা করতে দিচ্ছে বলেই করছো। এই বার্তাটি হলো পুরুষতন্ত্রের দুর্বিনীত ক্ষমতার বার্তা। নারীর প্রতি সহিংসতার জমি তৈরি হয় এভাবেই। এই মানসিকতাই স্বচ্ছন্দ্যে-সানন্দে নারীর দেহ এবং শ্রমের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
পুরুষতন্ত্র মানসিকতার রাজনীতি কখনো স্বীকার করবে না যে, রাষ্ট্র ও সমাজ কোনো না কোনোভাবে নারী নির্যাতনের অংশীদার। রাষ্ট্রের মদত না থাকলে নারীপাচার, হত্যা, ধর্ষণ চলতে পারে না এতো ব্যাপকহারে। রাষ্ট্রের সেই মুখ বদলাতেই আমাদের নারীরা, সাম্যবাদে বিশ্বাসী পুরুষরা রাস্তায় নামে, ধর্ষণের আইন বদলাতে চায়, প্রশাসনের নিয়ম-কানুনে নারীর জায়গা করে দিয়ে বলতে চায় এই দেশ নারীদেরও। কিন্তু পুরুষতন্ত্র বারবরই চায় রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে নারীদের সক্ষমতায় আঘাত করতে। শাসকরা ইচ্ছাকৃতভাবে, শয়তানি করে নারীদের পিছিয়ে রাখে বিষয়টা ঠিক এমন নয়। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভেতর একটা মজ্জাগত পুরুষতন্ত্র আছে যা সর্বব্যাপী।

আধুনিক সভ্যতার প্রদীপের আলোর নিচেই থাকে গভীর অন্ধকার। সেখানে এখনো নারীরা আলোর পথ খুঁজছেন। নানা কিছু ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো বহু পুরনো মানসিকতা দানা বেঁধে রয়েছে আমাদের ভেতর। সেটাই মাঝে মাঝে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আসলে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে কীভাবে নারীকে দেখতে হবে। ডেইজী সারওয়ার নিজেও যে রাজনীতি করেছেন, যেভাবে করেছেন বা করছেন সেটাও সেই কাঠামোরই রাজনীতি। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি পুরুষতন্ত্রের কারখানা থেকে। রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি শুধুই উপস্থিতি, তারা সেখানে দেখার বস্তু। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীলভাবে ট্রলের শিকার হতে হয় তাদের। লেখক : সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট। (ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়