মারুফ রসুল : এই যে কাঠমোল্লারা ওয়াজের নামে যা-তা মিথ্যাচার করছে, এমন সব বক্তব্য দিচ্ছে যেগুলো ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অনুসারীদের জন্যও অপমানজনক তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। ওয়াজ মাহফিলের নামে নারীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া এ সব তো চলছেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ওয়াজ মাহফিল ও তার মূর্খ বক্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চললেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিষয়ে কোনো শক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নজির আমাদের চোখে পড়ে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বরং সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘শরীয়ত বয়াতি নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করেছিলো’।
প্রধানমন্ত্রী যখন এমন বক্তব্য দেন, তখন সেটি কেবল শরীয়ত বয়াতির ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এর অর্থ দাঁড়ায় ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনার সময় আটক নির্দোষ রসরাজ দাসও তবে কোনো অপরাধ করেছিলেন। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে ঘটে যাওয়া নৃশংসতায় সেখানকার বৌদ্ধপল্লীর অধিবাসীরাও তবে অপরাধ করেছিলেন। এ হচ্ছে প্রকৃত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটি ধরন মাত্র। শরীয়ত বয়াতির নির্দোষ বক্তব্যকে ঘিরে যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করলো, যারা গ্রেপ্তার করলো তারা আজ বগল বাজিয়ে বলে বেড়াবে তারাই ঠিক। যেমন ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা যাচ্ছেতাই বলে আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে ‘বলেন ঠিক কিনা’ আর উপস্থিত জনতা দ্বিগুণ চিৎকারে জবাব দেয় ‘ঠিক, ঠিক’। তো এদের বিরুদ্ধে আমাদের তথাকথিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেয় না কেন? নেয় না কারণ রাষ্ট্র জানে ‘বলেন ঠিক কিনা’ আর ‘ঠিক ঠিক’ এই সওয়াল-জবাবের মাঝে বাংলাদেশ লটকে আছে।
রাষ্ট্র জানে তারেক মনোয়ার, আজহারীরা বা তাদের ওস্তাদ রাজাকার সাঈদী একধরনের আফিমের সওদা করে। সেই আফিম লাখ লাখ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সাহায্য করে। তারা যাই বলুক না কেন, যতো অযৌক্তিক, হাস্যকর বক্তব্যই দিক না কেনো মুসলমান জনগোষ্ঠী সেটা গিলে খায় এবং প্রায় অসম্ভব মনে হলেও কীভাবে যেন হজমও করতে পারে। তাহলে সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে নেতানেত্রীদের দেওয়া বক্তব্যে যে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানে’র কথা আসে, সেই মুসলমান কি আসলে বোকা? তারা সত্যিই কি বিশ্বাস করে আফগানিস্তানে বোমা মারলে তা ফুটে না, দ্রুতগামী রকেটে করে তারেক মনোয়ার ভ্রমণ করে, আইফোনের মালিক বেলগ্রেড বা তিনবার অক্সফোর্ডের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েছিলো কেউ এ সব সত্যিই তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করেন?
উত্তরটা হচ্ছে ‘না’। যদি ‘না’-ই হবে উত্তর, তবে যারা নিজেদের ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে দাবি করেন, তারা কেন এর প্রতিবাদ করেন না? কেন তারা বলেন না ওয়াজ মাহফিলের নামে যে সব কথা বলা হচ্ছে তা তাদের ‘ধর্মানুভূতি’তে আঘাত দিচ্ছে। এ সব ওয়াজ মাহফিল ‘ইসলাম’কে হেয় প্রতিপন্ন করছে। এখানেই ‘অর্থোডক্স’ ও ‘ফান্ডামেন্টালিস্টে’র মধ্যবর্তী পাতলা পর্দাটি উবে যায়, ফলে ভেদটাও ঘুচে যায়। অতএব, দিন শেষে আজকের বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে লালন, শাহ আবদুল করিম, জালাল উদ্দিন খাঁ, সাইদুর রহমান বয়াতি বা বাউল-দর্শনের মর্মকথা অপাঙক্তেয় হয়ে গেছে। আমরা যতোই হাসি-তামাশা বা প্রতিবাদ করি না কেন তারেক মনোয়ার, আজহারী বা সাঈদীর এ সব ওয়াজওয়ালা তোষ্য পুত্ররাই আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিকরা স্বাধীন হয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালের পর কেবল কাঠমোল্লা, ফতোয়াবাজ আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা ইতরদের স্বাধীনতা টিকে আছে।
আপনার মতামত লিখুন :